সুরেশ্বর বেশ অবাক হয়ে হৈমন্তীকে দেখল। বলল, যাদের রাখো তাদের কথা তোমার মনে থাকে না!
তিরস্কার নয়, ভর্ৎসনা নয়, তবু বেশ বোঝা গেল সুরেশ্বর হৈমন্তীর দায়িত্বহীনতার জন্যে ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত।
হৈমন্তী যতটা জেদ প্রকাশ করতে চাইছিল, পারল না; বরং সামান্য অস্বস্তি অনুভব করল।
সুরেশ্বর বলল, কবে ফিরবে?
হৈমন্তীর ইচ্ছে হল বলে, ফিরব না; কেন ফিরব? এখানে কী আছে?
হৈমন্তী নীরব। সুরেশ্বর নিজেই বলল, যাবার আগে রুগিদের যাদের পার ছেড়ে দিয়ে যেও। নতুন আর নিও না এ কদিন। ফিরে এসে…
হৈমন্তী বলল, আমি কদিন পরে ফিরব।
দেরি করবে?
না, তবে মা যদি দেরি করায়
এখানে খুব অসুবিধেয় পড়তে হবে। …আগে যিনি আসতেন তাঁকে তো এখন আর পাব না। রুগি এসে ফিরে যাবে।
রোগী এসে ফিরে গেলেই সুরেশ্বরের দুঃখ, আর কেউ ফিরে গেলে তার গায়ে লাগে না।
বিরক্তি ও বিতৃষ্ণা বোধ করে হৈমন্তী বলল, তা হলে যাব না।
সুরেশ্বর হৈমন্তীর গলার স্বর শুনে তার মুখভাব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করল। হেসে বলল, তুমি রাগ করছ হেম!
হৈমন্তী কথা বলল না, ইচ্ছে হল না।
সামান্য সময় সুরেশ্বরও কথা বলল না, তারপর আস্তে করে বলল, আমি দেখছি এখানে তোমার তেমন ভাল লাগছে না। তুমি এখনও মন বসাতে পারলে না। ভেবেছিলাম, আস্তে আস্তে বসে যাবে।
যাবে হয়তো–, হৈমন্তী আচমকা বলে ফেলল, বলার মধ্যে দুঃখ ছিল, শ্লেষও ছিল।
সুরেশ্বর প্রথমে হৈমন্তী পরে জানলার দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকল। হৈমন্তী ঘরের অন্ধকার দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে। সুরেশ্বরের এই ঘর ছোট, আসবাবপত্র সামান্য কিছু তার লেখাপড়া কাজকর্ম করার ঘর এটা, বইপত্র, কাগজ, দু-একটা দরকারি জিনিসে ভরা। টেবিলের ওপর কাচের প্লেটে শিউলিফুল, বাতাসে গন্ধ এল হালকা।
সুরেশ্বর বলল, হেম, তুমি কেমন হয়ে গেছ।
এই প্রথম, এখানে আসার পর সুরেশ্বর সরাসরি হৈমন্তীকে এমন কিছু বলল যা তাদের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে সুরেশ্বরের দিকে পলকের জন্য তাকাল, তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। বলল, বদলে গিয়েছি?
বোধহয়।
তুমিও।
গিয়েছি। আমার বদলের কথা তুমি জানতে না?
না।
না?
কী করে জানব!
আমি তো তোমায় অনেক আগেই জানিয়েছিলাম।
আমি বুঝিনি। …তোমার সব কথা বুঝব এমন বিদ্যেবুদ্ধি আমার নেই।
সুরেশ্বর অনেকক্ষণ যেন হৈমন্তীর দিকে মুখ ফিরিয়ে একদৃষ্টে কিছু দেখল। তারপর মৃদু গলায় বলল, আমি হয়তো তোমায় বোঝাতে পারিনি। থামল একটু, তারপর আবার বলল, আমি তোমায় এখানে দুঃখ দিতে আনিনি, হেম।
তোমার সুখ দুঃখ বোধ আলাদা।
কারও দুঃখে আমার সুখ নেই।
কথাটা হৈমন্তী শুনল, অর্থটাও বুঝতে পারল। সুরেশ্বরের সুখ-বোধ সে বোঝ না। প্রসঙ্গটা তর্ক করার মতন নয়, হৈমন্তীর তেমন কোনও ইচ্ছেও হল না।
সুরেশ্বর অনেকক্ষণ আর কথা বলল না। নীরব। হৈমন্তীও স্থির নিশ্চল হয়ে বসে। বাইরে কোথাও একটা পোকা ডাকছিল-চিপ চিপ। ঘরের অন্ধকার কোণে একটা জোনাকি এসেছে, জ্বলছে, নিবছে। দুজনের নীরবতার মধ্যে কেমন এক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়ে ক্রমশ তা এক দুস্তর ব্যবধানের মতন হয়ে উঠেছিল।
শেষে সুরেশ্বরই কথা বলল। এখানে তোমার ভাল লাগছে না।
না।
কলকাতায় ফিরে যেতে চাও?
ফিরে যাবার কথা বলিনি।
এখানে ভাল না লাগলে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কী করার আছে?
হৈমন্তী এবার মুখ ফিরিয়ে সুরেশ্বরকে দেখল। টেবিল বাতির ম্লান আলোয় যে-মুখটি হৈমন্তীর দৃষ্টিগোচর হল তার প্রতি সে আজ আর মমতা অনুভব করল না। ওই নিস্পৃহ মুখকে তার অত্যন্ত স্বার্থপর ও নিষ্ঠুর মনে হল।
ফিরে যাবার কথা এখনও ভাবিনি—
হৈমন্তী বলল, অগোছালো ভাবে।
কিন্তু তোমার যদি ভাল না লাগে—
ভাল লাগা না লাগার প্রশ্নটা অবান্তর। হৈমন্তী সংক্ষেপে বলল, রোজই তো রুগি দেখছি।
দেখছ, তবে মন পাচ্ছ না হয়তো।
আমার সাধ্যমতো যত্ন করে আমি রুগি দেখি।
ভালবেসে দেখ না?
ডাক্তারদের কাছে যত্নটা বড়, ভালবাসা নয়।
তুমি কর্তব্যের কথা বলছ।
তার বেশি আমার প্রয়োজন নেই। …আমার কাজ আমি বুঝি।
সুরেশ্বর আর কথা বলল না। বলা নিরর্থক।
দুজনেই আবার নীরব হয়ে বসে থাকল। অন্ধকার দেওয়ালের কোণ থেকে জোনাকিটা হৈমন্তীর পায়ের দিকে উড়ে এসেছিল, কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
বসে থেকে থেকে হৈমন্তী উঠল। বলল, হাত কেমন আছে?
ভাল।
কাল দেখব। …যাই। হৈমন্তী চলে যাচ্ছিল।
সুরেশ্বর বলল, মাসিমাকে চিঠি লিখে দিয়ো৷ কবে যাচ্ছ জানিয়ো
হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। চলে গেল।
.
হৈমন্তী চলে গেলে সুরেশ্বর বসে থাকল, একই ভাবে, শান্ত স্থির হয়ে। কিছু সময় এইভাবে কাটল; ভরতু ঘরে এসেছিল, তার পায়ের শব্দ শুনল সুরেশ্বর; কাজ সেরে ভরতু চলে গেল। সর্দির জন্যে চোখ এবং কপাল সামান্য ভারী লাগছিল সুরেশ্বরের।
মন খানিকটা বিক্ষিপ্ত হয়েছিল, আস্তে আস্তে তা শান্ত ও সংযত করে ফেলেছে সুরেশ্বর, এখন অনেকটা শান্ত ভাবেই ভাবার চেষ্টা করছিল, হৈমন্তীকে এখানে আনা তার উচিত হয়েছে কি না!
হেম এখানে সুখী নয়, সন্তুষ্ট নয়। আসার পর পর প্রথম দিকে ওর চোখে মুখে কিছু বিস্ময় ছিল, কলকাতা শহর থেকে হঠাৎ এই নির্জনে এসে পড়ার বিস্ময় হয়তো, হয়তো এই আশ্রমের পরিবেশ, এখানকার জীবনযাপন তার কাছে অপরিচিত ও অনভ্যস্ত বলে সাধারণভাবে সে অবাক বোধ করত। কয়েক দিনের মধ্যে সে বিস্ময় কেটে গেল। তারপর থেকে হৈমন্তী আর প্রসন্ন নয়। এখন তার কথাবার্তা থেকে বেশ বোঝা যায়, হেম অসন্তুষ্ট, ক্ষুণ্ণ, মনোভারে পীড়িত। এখানে সে নিঃসঙ্গ ও একাকী।