হৈমন্তী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মুখ ফেরাতেই অবনীর সম্মোহিত বেদনাপূর্ণ চক্ষু দুটি দেখতে পেল।
.
০৯.
আচমকা একদিন মাঝরাতে ঝড় বৃষ্টি নামল। পরের দিন সারাটা সকাল কখনও ঝড়, কখনও বৃষ্টি, আকাশ জুড়ে শুধু মেঘ ভেসে চলেছে, যেন একপাশ থেকে কেউ মেঘের ফিতে খুলে দিচ্ছে, অন্য পাশে আর-কেউ গুটিয়ে নিচ্ছে, বিকেলে শাল-গরগলের বনে আবার বুঝি নতুন করে বাদলার পালা নামল, বৃষ্টির ঝাঁপটা দেওয়া বাতাস আসছিল ক্ষণে ক্ষণে; সারা রাত ধরে মেঘ ডাকল গুরুগুরু, বিদ্যুৎ চমকাল আর বৃষ্টি পড়ল। মনে হচ্ছিল, আশ্বিনের শেষে শ্রাবণের ধারা নামল। পরের দিন সকালে আকাশ পরিষ্কার,নভোমণ্ডল নীলের সমুদ্র, কোথাও যেন মেঘের আঁশ নেই, ঝকঝক করছে রোদ, রোদের মধ্যে কোথাও একটু আমেজ পাওয়া গেল শীতের।
আশ্রমের কয়েকটা পলকা গাছ এই ঝড়ে বৃষ্টিতে ছন্নছাড়া চেহারা করে দাঁড়িয়ে থাকল, লতাপাতা ফুল দলিত মথিত, জল, জলের ওপর মাথা উঠিয়ে ঘাসের শিস বাতাসে কাঁপছিল।
কেমন করে যেন এই দুর্যোগে হাতের খানিকটা কেটে গিয়েছিল সুরেশ্বরের, শার্সির কাঁচ ভেঙে বিছানায় ছড়িয়ে পড়েছিল; তার ওপর ডান পায়ের গোড়ালি মচকে গিয়ে হাঁটাচলাও কষ্টকর করে তুলেছিল। দু-তিনটে দিন সামান্য অসুস্থ থাকল সুরেশ্বর।
সেদিন সন্ধেবেলায় ঘরে ক্যাম্বিসের চেয়ারে সুরেশ্বর শুয়ে, মালিনী অন্ধকুটিরের সামনের ডাল-ভাঙা গাছ থেকে একরাশ শিউলি ফুল এনে কাচের প্লেটে রেখে দিল, বলল: একটু চুনহলুদ গরম করে দেব, লাগাবেন?
সুরেশ্বর মাথা নাড়ল, বলল, না। তারপর কী মনে করে বলল, চুনহলুদ নয়, একটু গরম চা করে খাওয়া তো মালিনী, সর্দি সর্দি লাগছে। মালিনীকে কখনও কখনও আদর করে সুরেশ্বর তুই টুই বলে।
একটু পরেই হৈমন্তী এল। মালিনী চা দিয়ে চলে গেল।
এসো হেম, তোমার কথাই ভাবছিলাম। সুরেশ্বর বলল হালকা গলায়, চা খেতে খেতে।
হৈমন্তী সামনাসামনি বসল। মালিনী তাকেও চা দিয়ে গেছে।
তুমি নাকি কলকাতায় যাচ্ছ? সুরেশ্বর শুধোল।
হৈমন্তী তাকাল, মুখ দেখল সুরেশ্বরের। মা কি সুরেশ্বরকেও চিঠি লিখেছে? বলল, মা যেতে লিখেছে।
আর মাত্র সাতটা দিন পরে পুজো। কলকাতা থেকে মা যেতে লিখেছে। না লিখলেও যাবার কথা ভেবেছিল হৈমন্তী। এখানে সে মন বসাতে পারছে না, ভাল লাগছে না। কলকাতাতে কটা দিন কাটিয়ে আসতে পারলে ভাল হত। নিজের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে মনটা হালকা হত খানিক। অথচ কী করে যে যাবে বুঝে উঠতে পারছিল না। সুরেশ্বর কি হাসপাতাল বন্ধ রাখতে রাজি হবে? নিজেও যে হাত কেটে পা মচকে বসে আছে। কথাটা মনে মনেই রেখেছিল হেম, ভেবেছিল পরে বলবে। হয়তো আজও বলত। সুরেশ্বর তার বলার আগেই জেনে গেছে। মা কি সুরেশ্বরকে লিখেছে কিছু!
মা চিঠি লিখেছে? হৈমন্তী জানতে চাইল।
না, মালিনী বলছিল।
ও!
মালিনীর ওপর ঈষৎ বিরক্তি অনুভব করল হৈমন্তী। মালিনীর বলার কী ছিল! মাতব্বরি!
ভাবছিলাম যাব, হৈমন্তী বলল।
সুরেশ্বর কিছু ভাবছিল, বলল, কবে যাবে?
দেখি, এখনও কিছু ঠিক করিনি; ষষ্ঠীর দিন যাব ভাবছি।
চিঠি দিয়েছ মাসিমাকে?
না, দেব।
হাসপাতাল একেবারে বন্ধ রাখবে?
সুরেশ্বর এমনভাবে বলল যেন হাসপাতালটা হৈমন্তীর। ভাল লাগল না শুনতে। কার হাসপাতাল, কে যে বন্ধ রাখছে! হৈমন্তী অপ্রসন্ন হয়ে মনে মনে বলল: তোমার হাসপাতাল, তুমিই জানো।
আর-একটু ভেবে সুরেশ্বর বলল, এ-সময় এদিকে ওরা মেলা-টেলায় যায়, দশহরা-টরা করে, হাসপাতালে বড় কেউ আসে না। তা বেশ তো, তুমি যাও।
হৈমন্তীর মনে হল, সুরেশ্বর যেন তার ছুটি মঞ্জুর করল। অবশ্য ছুটি দেবার আগে নিজের প্রয়োজনটা হিসেব করে দেখে নিল। সে কলকাতায় যেতে চাইছে এটা বিবেচনার বিষয় নয়, রুগিটুগি আসতে পারে কি না সেটাই সুরেশ্বরের বিবেচনার বিষয়।
হৈমন্তী এখানে চাকরি করতে আসেনি, তার পরিশ্রমের মূল্য সে নেয় না। স্বেচ্ছায় সে এসেছে, যা করছে তা নিঃস্বার্থে, নিতান্ত দয়াপরবশে। তার ইচ্ছেতেই সে যেতে পারে, অন্য কারও ইচ্ছার ওপর তার আসা-যাওয়া নির্ভর করে না। রোগীরা আসবে কি আসবেনা তার ওপর হৈমন্তীর কলকাতা যাওয়া স্থির হবে! আশ্চর্য!
মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও হৈমন্তী মুখে কিছু বলল না।
সুরেশ্বর বলল, যাবার আগে তোমার এখানের রুগিদের ছেড়ে দিয়ে যেতে পারবে না?
আবার সেই তোমার রুগি! সুরেশ্বরের এই তোমার হাসপাতাল, তোমার রুগি কথাগুলো ভাল লাগে না হৈমন্তীর। এরা বাস্তবিকই তার কিছু নয়। সুরেশ্বর যেন ইচ্ছে করে বার বার তাকে হাসপাতাল, রোগী, আশ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে দিতে চায়। এখানে আমার কিছু নেই, ওরা কেউ আমার নয়–হৈমন্তীর এই সরল মনোভাবটা কি সুরেশ্বর বোঝে না; অথবা বোঝে বলেই ধীরে ধীরে বুদ্ধিমানের মতন হৈমন্তীকে এই আশ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলতে চাইছে। হয়তো সে ভাবছে, হৈমন্তীকে এই ভাবে দুর্বল করা যায়, মোহের মধ্যে জড়িয়ে ফেলা যায়। সংসারে বহু মানুষ এইভাবে মজে, এই ফাঁদে পা দেয়।
হৈমন্তী হঠাৎ এক ধরনের জেদ অনুভব করল। সুরেশ্বর তাকে যেখানে ঠেলে দিতে চাইছে সেখানে সে যাবে না, বাধা দেবে। বলল, কারা আছে আমার মনে নেই। তার সবই মনে ছিল। যারা আছে তাদের ছেড়ে দিতেও কোনও বাধা নেই। অনেক সময় এরা অনেকটা দূর থেকে খুব কষ্ট করে আসে। দু-চার দিন পরে আবার কাটাকুটি দেখাতে আসা সম্ভব নয় বলেই কয়েকদিন রেখে দেওয়া হয়, নয়তো রাখার অর্থ নেই।