অবনী যেন কিছু ভাবল। বলল, আপনার ঈশ্বরে পাপ নেই?
না। পাপ কি মানুষের গুণ?
কিন্তু মানুষের মধ্যে আছে।
পবিত্রতা তাই আমাদের কল্পনা।
অবনী কিছু বলল না আর। সুরেশ্বরের ঈশ্বর যে কিছুটা এলোমেলো, সাদামাটা তাতে তার সন্দেহ হল না। বোধহয়, অবনীর মনে হল, ঈশ্বরকে রাখলে অপ্রয়োজনে রাখতে হয়, না হয় রাখতে নেই। সুরেশ্বর প্রয়োজনে ঈশ্বরকে রেখেছে। সে নির্বোধ। তবু অবনীর কোথাও যেন সুরেশ্বরের প্রতি সহানুভূতি ও মমতা হচ্ছিল।
গাড়ি অন্ধ আশ্রমের কাছাকাছি এসে পড়েছিল। আর অল্পক্ষণ পরেই আশ্রমে পৌঁছে যাবে। কেমন এক অবসাদ বোধ করছিল অবনী। অবসন্নভাবে সিগারেট ধরাল, গলা বুক ভরে ধোঁয়া নিল। কিছুক্ষণ আর কোনও কথা হল না। দুজনেই নীরব।
অবশেষে অবনী বলল, আপনি এই অন্ধ আশ্রম করতে এলেন কেন? সংসারে আরও অনেক কাজ ছিল।
সুরেশ্বর সামান্য ভেবে বলল, এই কাজটাই আমার ভাল লাগল।
অন্ধ আতুর সেবা?
দুঃখীজনের সেবা। …আমিও তো অন্ধ। সুরেশ্বর সামান্য থামল, বলল, একবার আমি এক গেঁয়ো মেলায় গিয়েছিলাম। মেলাটা বসে মাঘ মাসের পূর্ণিমায় শোন নদীর ধারে। হরিদ্বারের গঙ্গায় যেমন লোকে সন্ধেবেলায় প্রদীপ ভাসায়–সেই রকম এই মেলাতেও অনেকে মাটির প্রদীপ ভাসাতে আসে। ভাবে এটা পুণ্য কাজ। সেবার একটা বুড়ো এসেছিল। প্রদীপ ভাসাতে গিয়ে কেমন করে যেন নদীতে পড়ে গেল। তাকে টেনেটুনে তুলল লোকে। বুড়ো অন্ধ। আমি বললাম, তুমি নিজে অন্ধ তবু এভাবে একলা একলা প্রদীপ ভাসাতে এলে কেন? জবাবে বুড়োটা বলল,-বেটা, আমি আজন্ম অন্ধ, আমি ছোট, তবু যখন এই একরত্তি মাটির পিদ্দিমে এক ফোঁটা আলো দিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দি, তখন বুঝতে পারি আমার ছোট্ট পিদ্দিমটা হাজার মানুষের আলোর সঙ্গে নদীর ঘাট ভাসতে ভাসতে কোথায় যেন চলে গেল। জীবনকে এইভাবে যেতে দাও।
অবনী অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি কি কোনও কিছু পাবেন? অন্ধ তো পথ পায় না।
মানবজীবনের একটা দিক এই রকমই। দুঃখের জগতে, যন্ত্রণার জগতে আমরা জন্মেছি। তেমন করে দেখতে গেলে ব্যর্থতাই মানুষের নিয়তি। …তবু..
অবনী অপেক্ষা করে থাকল।
সুরেশ্বর বলল, তবুজগতের সঙ্গে জীবনের সঙ্গে কর্ম দিয়ে যে জড়িত তার সান্ত্বনা আছে। আমি নিষ্ক্রিয় হয়ে বাঁচতে পারি না। অবিশ্বাস করে, দূরে সরে থেকে, পালিয়ে যদি বাঁচা যেত আমি বাঁচতাম।
এই বেঁচে থাকায় কিছু কি আছে?
আমি ভাবি, আছে। মর্যাদা আছে, সান্ত্বনা আছে।
আশ্রমের সামনে এসে গাড়িটা লাফাল। গর্ত ছিল কোথাও। অবনী ব্রেক চাপল, তারপর আশ্রমের মধ্যে ঢুকে গেল। অন্য দিনের মতনই সে গাড়িটা হৈমন্তীর ঘরের কাছাকাছি মাঠে রাখল। তার খেয়াল ছিল না হয়তো, কিংবা অভ্যাসবশেই।
সুরেশ্বর নামল, অবনীও নেমে পড়ল।
সুরেশ্বর বলল, নামলেন? বসবেন একটু?
না। আপনাকে একটু এগিয়ে দিই। পা ছাড়িয়ে নিচ্ছি আর কি! অবনী হাসল।
মাঠ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ্বরের ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা।
সুরেশ্বর বলল, অবনীবাবু
বলুন।
হেম আমার অনেক অহঙ্কার ভেঙেছে। তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। থামল, আবার বলল, সেই যে গান আছে: যতবার আলো জ্বালাতে চাই নিবে যায় বারে বারে আমারও তাই। নিজেকে জ্বালাতে চাই, তবু নিজেই কোথায় যেন নিবিয়ে ফেলি।
অবনী সুরেশ্বরকে দেখল। সুরেশ্বর শান্ত পায়ে সামনের দিকে চোখ রেখে হেঁটে চলেছে। তার শরীরের কোথাও অবনত ভাব নেই, দ্রুততা নেই পদক্ষেপে, অথচ, সে নম্র, বিনীত। মনে হয় সে কোনও কিছু লক্ষ করছে না, অথচ সে লক্ষ করছে।
ঘরের সামনে এসে সুরেশ্বর ডান দিক দিয়ে আরও একটু এগিয়ে গেল, গিয়ে হরীতকী গাছের তলায় সিমেন্টের ছোট একটি বেদির সামনে দাঁড়াল। বলল, বসব একটু। বসবেন?
না, আর বসব না। অবনী মাথা নাড়ল। সুরেশ্বর যে এখন একা নির্জনে নিস্তব্ধতার মধ্যে দুদণ্ড বসে থাকতে চায় অবনী অনুভব করতে পারছিল। আর অপেক্ষা করা যায় না। অবনী বলল, চলি, রাত হয়ে আসছে…।
আসুন। …আবার আসবেন।
আসব, অবনী অন্যমনস্কভাবে বলল, আচ্ছা চলি।
ফিরতে লাগল অবনী। সুরেশ্বরের ঘরের সামনে দিয়ে চলে এল। আরও কয়েক পা এগিয়ে দাঁড়াল: সুরেশ্বরকে দেখতে ইচ্ছে করছিল৷ পিছু ফিরে তাকাল: সিমেন্টের বেদির ওপর আসন করে সুরেশ্বর বসে আছে, পাশে হরীতকী গাছ, মনে হল সুরেশ্বরের মুখ আকাশের দিকে। ফাল্গুনের নিশীথ বাতাস ও কোমল জ্যোৎস্নার মধ্যে তাকে এখন বড় দূরের বলে মনে হচ্ছিল। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে অবনী আবার ফিরতে লাগল।
মাঠ দিয়ে অন্যমনস্কভাবে অবনী হাঁটছিল: ঘাসে বুঝি সামান্য হিম পড়ে আর্দ্র হয়েছে, করবীঝোপ মাঝে মাঝে শিহরিত হচ্ছিল, কদাচিৎ কারও গলার স্বর ভেসে আসছে, দু-একটি আলো জ্বলছে কোথাও! অবনী কিছু লক্ষ করল না; সরাসরি এসে গাড়ির কাছে দাঁড়াল।
অন্যমনস্কভাবে অবনী গাড়িতে উঠল, উঠে অভ্যাসমতন গিয়ারে হাত দিল। স্টার্ট দেওয়ার পর যেন শব্দ এসে তাকে সচেতন করল। হেডলাইট জ্বালাল অবনী। আলোর ঢেউ যেন সামান্য ব্যবধানটুকু নিমেষে পেরিয়ে গেল, গিয়ে হৈমন্তীর ঘরের দিকে আছড়ে পড়ল। মুহূর্তের জন্যে কেমন বিভ্রম ঘটল, তারপর অবনীর মনে হল হৈমন্তী নেই, তার ঘর শূন্য পড়ে আছে। ফাঁকা, রিক্ত, নিঃস্ব মনে হল নিজেকে বুকের কোথাও যেন কিছু নেই–সব কেমন অসাড়, শূন্য। মুখ হাঁ করে গভীর শ্বাস ফেলল। তারপর গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে নেবার জন্যে সামান্য পিছিয়ে এগিয়ে নিল গাড়িটা, নিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে আনল। ঘুরিয়ে নেবার সময় হেডলাইটের আলো প্রথমে অন্ধনিবাস, পরে রোগী-ঘর, তাঁত-ঘর এবং শেষে পেট্রম্যাক্স-জ্বালানতুন হাসপাতালের গায়ে গায়ে পড়ল, পড়ে ঘুরে এল। আর সহসা অবনীর মনে হল, এই আলো অতি তীব্র, ভীষণ; মনে হল এই আলোর কৌতূহল বড় বেশি; যেন শিকারের আগ্রহে সতর্ক হয়ে তন্ন তন্ন করে সব দেখতে চায়। নিষ্ঠুর, নির্দয়। আর কেন যেন অবনীর অদ্ভুত এক অস্বস্তি হল। সে আড়ষ্ট ও ভীত হল। গাড়ির আলো দুটিকে নিজের চক্ষু বলে মনে হচ্ছিল। হয়তো অবনী সুরেশ্বরের এই আশ্রমে ক্ষিপ্তের মতন, নির্বোধের মতন এবং নির্দয় হয়ে বেমানান, অপ্রয়োজনীয় আলো নিয়ে এখানকার সমস্ত কিছুকে অবজ্ঞা ও উপহাস করতে এসেছিল, হয়তো শিকার করতে।