অবনীর ইচ্ছে হল বলে, কেন-সুরেশ্বর? সুরেশ্বর আপনার সঙ্গী নয়? মুখে বলল, সুরেশ্বরবাবু তো রয়েছেন। ..
হৈমন্তী চোখের পাশ দিয়ে অবনীকে দেখল। বলল, উনি কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন– বলে থামল কয়েক মুহূর্ত, তারপর হাসির মুখ করে বলল, ওঁর কাছে বসে থাকলে আশ্রমের কথা বড় বেশি শুনতে হয়।
অবনী মুখ ফিরিয়ে হৈমন্তীকে লক্ষ করল, বলল, এই আশ্রমের ওপর আপনার অচলা ভক্তি দেখছি না তো। বলে হাসল অবনী।
কেন! আছে তো৷
না। তেমন টান কই!
হৈমন্তী চুপ। মনে হল বলে, না–আমার বিন্দুমাত্র টান নেই, আমি এসব গ্রাহ্য করি না, আমার ভাল লাগে না। এ আশ্রম আমার নয়।
আশ্রমের প্রসঙ্গে হৈমন্তীর আর ভালও লাগে না। এর বাইরে কি কিছু নেই। সাধারণ মানুষ আমি, সাধারণ কথাই আমার কাছে ভাল। অন্য গল্প, আর পাঁচটা অন্য কথা বলতে পারলে সে খুশি হবে।
হৈমন্তী বলল, আপনাকে এখানে কী করতে হয়? কাজের কথা বলছি।
কিছুই না, অবনী হেসে জবাব দিল। তারপর সে তাদের কাজকর্মের কথা বুঝিয়ে বলল।
মালিনী চা নিয়ে এল।
অবনীর হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে হৈমন্তী বলল, আপনি মালিনীকে চেনেন না? …মালিনী বড় ভাল মেয়ে। …ওর কী একটা কাজ ছিল আপনার কাছে। বলো না মালিনী।
মালিনী বোকা ও বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হেমদি তাকে অপ্রস্তুতের একশেষ করল। মুখ তুলতে পারল না।
হৈমন্তী নিজের চায়ের পেয়ালা নিয়েছে। মালিনীর অবস্থা দেখে হেসে ফেলল, দুঃখও হল। অবনীও দেখছিল মালিনীকে।
শেষ পর্যন্ত হৈমন্তীই মালিনীর আবেদনটুকু জানাল। মালিনী আর দাঁড়াতে পারল না, পালিয়ে গেল।
অবনী সংক্ষেপে বলল, দেখি কী করা যায়।
চা খেতে খেতে টুকরো আরও কিছু কথা হল, সাধারণ আলাপ। হৈমন্তী হালকা মনে পারিবারিক কথা, কলকাতার গল্প করছিল। তার ভাল লাগছিল। তারপর কী কথায় যেন তার এখানে আসার প্রথম দিনটির কথা উঠল। বলল, সেদিন যখন এই জঙ্গলে এসে রাস্তায় বাস খারাপ হয়ে গেল, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। কপাল ভাল, আপনার সঙ্গে দেখা হল।
অবনী বলল, তার খানিকটা আগে আমিও ভয় পেয়েছিলাম।
আপনি…! কেন?
কী জানি। …হয়তো মৃত্যুভয়; হয়তো অন্য কিছু…
আমার মনে হয়েছিল আপনি খুব বিচলিত হয়ে পড়েছেন।
হয়েছিলাম। …হীরালাল বড় ভাল ছিল, চমৎকার ছেলে। ..সে বিয়ে করেছিল, বাচ্চা আছে। অথচ বেচারির জীবনটা কীভাবে নষ্ট হল। …মিনিংলেস।
হৈমন্তী তার পাশের মানুষটির মুখ দেখল। সংসারের সাধারণ বেদনায় এ মানুষ ব্যথা পায়, দুঃখ বোধ করে, চঞ্চল হয়। এর মধ্যে রক্তমাংস অনুভব করা যায়। সুরেশ্বর এরকম নয়; তার চঞ্চলতা নেই। নিরুত্তাপ। সমস্তই যেন বাইরের।
কী মনে হওয়ায় হৈমন্তী হঠাৎ বলল, আপনার স্বভাব দেখছি খুব নরম।
অবনী নীরব থাকল।
সামান্য পরে হৈমন্তী আবার বলল, আমি চোখের ডাক্তার, তবু ডাক্তার তো, একটা ডাক্তারি উপদেশ দি। মৃত্যুভয় বড় খারাপ, ওসব ভাববেন না, মন দুর্বল হয়। আন্তরিকভাবে গাঢ় সুন্দর গলায় হৈমন্তী বলল, মুখে সামান্য হাসি।
অবনী অল্প সময় চুপ করে থেকে বলল, সুরেশ্বরবাবু হলে অন্য কথা বলতেন..চন্দ্র সূর্য তারা..কত কথা। বড় বড় কথা শুনতে বেশ। আমার ভাল লাগে না। সমস্ত ব্যাপারে এত তত্ত্বের কী আছে!
উনি খানিকটা অন্যরকম। হৈমন্তী বলল।
কী জানি লোকে বলে। ..আগে তো দেখিনি।
উনি অন্ধ আশ্রম করতে এলেন কেন?
জানি না।
অবনী সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল। হৈমন্তী কি তাকে কথাটা বলতে চায় না? অথচ মুখ দেখে মনে হয় না সে কিছু গোপন করছে। বরং অবনীর মনে হল, প্রশ্নটা হৈমন্তীকেও কেমন অন্যমনস্ক, বিমর্ষ করেছে।
অবনী চুপ করে থাকল, হৈমন্তীও নীরব। অবনী চোখ ফিরিয়ে নিল, মাঠে ঘাসের ওপর জ্যোৎস্নার কেমন পালিশ ধরে আছে। দুরে তার জিপগাড়ি। মানুষের গলা প্রায় শোনাই যাচ্ছে না, নিস্তব্ধ।
কিছুক্ষণ মাঠের দিকে তাকিয়ে পরে অবনী চোখ ফেরাল, হৈমন্তীর দিকে তাকাল। হৈমন্তী কখন যেন একটু পাশ ফিরে বসে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। জ্যোৎস্নার মধ্যে ডুবে আছে হৈমন্তী। হঠাৎ দেখলে মূর্তির মতো মনে হয়। স্থির, নিঃসম্পর্ক, যেন মায়া অথবা ভ্রম। অবনী অপলকে দেখছিল: হৈমন্তীর মুখের গড়নটি ডিমের মতন, ছোট কপাল, গড়ানো মসৃণ গাল, টোল তোলা নরম থুতনি, নাক সোজা লম্বা। চোখ দুটি বড়, তবে অস্বাভাবিক নয়, টানাটানা চোখের পাতা, পাতলা ভুরু। হয়তো বয়সে, হয়তো কোনও রকম গাম্ভীর্যে ওর চোখ দুটি শান্ত। ঘাড় হাত পা কোথাও কোনও রকম বিকৃতি নেই, স্বাভাবিক, সুসমঞ্জস। হৈমন্তী সুশ্রী, লাবণ্যপূর্ণ। তার ফরসা গায়ের রং, প্রায়-সাদা শাড়ি, সাধারণ একটি এলো খোঁপা–এমন কিছু নয় যার দিকে অবনী নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকতে পারে।
অথচ অবনী সম্মোহিতের মতন তাকিয়েছিল। সে কী যেন অনুভব করছিল। ললিতাকে দেখার পর সে এরকম কিছু অনুভব করেনি, তার শরীর চঞ্চল ও ইন্দ্রিয়গুলি ক্ষুধার্ত হয়েছিল। হৈমন্তীকে দেখে ইন্দ্রিয়ের কোথাও তড়িৎ-উত্তেজনা অথবা জ্বালা অনুভব করছে না। সে কেমন বিক্ষিপ্তমন হয়ে পড়েছে, কোনও বেদনা বোধ করছে, যে-বেদনা বুঝি অগোচরে থাকে। হঠাৎ কেমন দুঃখী ও দীন মনে হল। অবনী অস্পষ্টভাবে অনুভব করল, তার হৃদয় সহসা শিশুর মতন অভিমানী ও কাতর হয়ে উঠে কিছু চাইছে।