অবনী নিশ্বাস ফেলল দীর্ঘ করে, কয়েক দণ্ড চুপচাপ, তারপর পকেট হাতড়ে সিগারেট বের করে ধরাল। হৈমন্তী এখন কতটা পথ চলে গেল, অবনী যেন মনে মনে ভাবল একবার।
গাড়ি আবার চলতে শুরু করলে অবনী বলল, বাইরের দুঃখই কি জীবনের সব?
সুরেশ্বর অন্যমনস্ক ছিল, শুনতে পায়নি। বলল, কিছু বললেন?
বলছিলাম বাইরের দুঃখই কি জীবনের সব?
যার কাছে যেমন…হেমের কাছে তার নিজের দুঃখই বড়।
আপনার দুঃখের সঙ্গে তার মিল নেই।
না।
কিন্তু, মানুষ নিজের সুখ দুঃখই তো আগে বোঝে।
অনেক সময় সেটাই একমাত্র বোঝে; আগে যা বোঝে–পরেও তাই বোঝে। আমার বাবা তাঁর জীবনে শুধু নিজের সুখ বুঝেছিলেন, নিজের অভাবটাই তাঁর একমাত্র বোধ ছিল।
আপনার মা আত্মহত্যা করেছিলেন কেন?
নিজের দুঃখে কোনও সান্ত্বনা পাননি বোধহয়।
অবনী আর কিছু বলল না। তার মনে হল না, বৃথা অন্য কোনও কথার প্রয়োজন আছে। সুরেশ্বর নিজের কথা ভুলতে চায়, তার নিজের সুখ দুঃখকে সে স্বীকার করে না, হৈমন্তীর সঙ্গে তার কোথাও মিল নেই, কোথাও নয়। কেন যে–অবনী বুঝতে পারল না–তার মার কথা মনে পড়ল; ললিতার কথা, এবং নিজের। মা শুধুমাত্র আত্মতৃপ্তি চেয়েছিল, সেই আত্মতৃপ্তির কী কুৎসিত পরিণতি! ললিতা কী চেয়েছিল, কী চায়? শুধু আত্মসুখ, সন্তুষ্টি, ভোগ। সে নিজেও ললিতার কাছে এর বেশি কিছু চায়নি। অবশ্য এ থেকে কিছু প্রমাণ করতে চাইছে না অবনী, তবু তার মনে পড়ছে। হয়তো সুরেশ্বরের কথায় কতটুকু সত্য সে দেখতে চাইছিল।
লাটঠার মোড়ের কাছাকাছি গাড়ি পৌঁছে গেল। ডান দিকে কয়েকটা খাপরাচালের ঘর দেখা যাচ্ছিল, ফাগুয়ার গান শুরু হয়েছে, বাতাসে একটা সুরেলা হল্লা ভাসছিল, খঞ্জনির শব্দ। ক্রমে লাটঠার মোড় এল। একটু আলো, ছোটখাট দু-একটা দোকান, দু-পাঁচজন মানুষ।
লাটঠার মোড় থেকে গাড়িটা কাঁচা রাস্তায় নামিয়ে নিল অবনী; তারপর মাঠ; আমলকী আর শালচারার ঝোপে লিটি পোকা টিপ টিপ করে জ্বলছিল, শুকনো মাটির গন্ধ। ধুধু প্রান্তরে এসে গাড়িটা উঁচু-নিচু পথে ঝাঁকুনি খেতে খেতে চলেছিল।
অবনী অনেকক্ষণ কোনও কথা বলেনি। এবার, নিশ্বাস ফেলে, আচমকা সুরেশ্বরকে ডাকল।
সুরেশ্বর সাড়া দিল।
অবনী বলল, আপনার সমস্ত জীবনটা আপনি এই জঙ্গলেই শেষ করে দিতে চান?
সুরেশ্বর কিছু বলল না, যেন বিনীত হাসি হাসার চেষ্টা করল, শব্দ হল সামান্য।
এখানে আপনি কী পেয়েছেন?
এত তাড়াতাড়ি! সুরেশ্বর এবার হাসল, শান্ত নির্মল ধ্বনি জাগল হাসির।
পাবার অপেক্ষায় আছেন? অবনীও পরিহাস করে হাসল।
তা হয়তো আছি।
পাবেন?
কী জানি; হয়তো পাব না। …বসে থাকলেই কি পাওয়া যায়!
অবনী সুরেশ্বরের মুখ লক্ষ করল। বলল, আপনি কী ঈশ্বরদর্শনের আশায় বসে আছেন?
না, সুরেশর মাথা নাড়ল।
অবনী অবাক হল। আপনি ঈশ্বর-বিশ্বাসী নন?
কী রকম ঈশ্বর?
অবনী কেমন গোলমালের মধ্যে পড়ল। সে বুঝতে পারল না সুরেশ্বরের প্রশ্নের কী জবাব হতে পারে। কেমন ঈশ্বর? কেন, আস্তিক যাকে ঈশ্বর বলে তেমন ঈশ্বর। অবনী বলল, ঈশ্বরের আবার রকম থাকে নাকি? ..কী জানি আমি জানি না, মশাই।
সুরেশ্বর সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিল না। পরে বলল, আমার ঈশ্বর আমার নিজের।
বুঝলাম না…
বুঝোনোর মতন কিছু নেই। সুরেশ্বর সংযত গলায় বলল, আমার ঈশ্বর নিয়ে বড়-সড় তর্ক করা যায় না। …জগৎ আর জীবের বাইরে সে-ঈশ্বর থাকে না।
কিন্তু আমার ধারণা ছিল ঈশ্বর বস্তুটা এই দুইয়ের বাইরে–সাম থিং এলস..
সে ঈশ্বরে আমার বিশ্বাস নেই। …আমার বেড়ার বাইরে যে ঈশ্বর তাকে নিয়ে আমি কী করব!
অবনী বুঝতে পারল না। বলল, আপনার ঈশ্বর কী?
কল্পনা।
সমস্ত ঈশ্বরই কল্পনা।
আমার ঈশ্বর মানুষের বোধবুদ্ধির অগম্য, অজ্ঞেয় অনুভব-হীন কল্পনা নয়। …মানুষের হৃদয় যা অনুভব করে আমার ঈশ্বরকে আমি তাই দিয়ে কল্পনা করেছি। মানুষ যা হতে চায়, অথচ পারে না, যা হতে পারলে সে ভাবে সে সার্থক হত, পূর্ণ হত, আমার ঈশ্বর তার বেশি নয়।
অবনী ইতস্তত করে বলল, তার দেবত্ব নেই?
না; সেভাবে নেই। সুরেশ্বর সংক্ষেপে বলল।
গাড়ি চলছে কী চলছে না বোঝা যায় না, শব্দটা কানের সঙ্গে মিশে আছে, ফাল্গুনের জ্যোৎস্নায় নিঃসাড় প্রান্তর কেমন অলৌকিক মগ্নতা পেয়েছে, ঝিঁঝির স্বরে এখানের শূন্যতা ভরে আছে।
সুরেশ্বর মৃদুস্বরে বলল, মানুষ তার সমস্ত অভাব, ব্যর্থতা, অপূর্ণতা, অক্ষমতার কথা নিজে যত জানে আকাশের ভগবান তত জানে না। ঈশ্বর আমার কাছে মানুষের কাম্য ও প্রার্থিত সমস্ত গুণের সমষ্টি। আমার ঈশ্বর নিগুণ নয়। সুরেশ্বর কয়েক মুহূর্তের জন্যে থামল, পরে বলল, মানুষ তার দয়া, মায়া, মমতা, প্রেম, শৌর্য, সৌন্দর্য-সমস্ত কিছুর চরম কল্পনা ঈশ্বরের ওপর আরোপ করেছে; তাই ঈশ্বরের চেয়ে মমতাময় প্রেমময় আর কিছুকে বলি না। অপূর্ণ মানুষের ধারণায় ঈশ্বরই তাই পূর্ণ। …এই দেবত্ব মানুষ শুধু ঈশ্বরকেই দিয়েছে, কারণ সে ভেবেছে এ-দেবত্ব বুঝি তার আয়ত্ত হবার নয়। বোধহয়, আমার ধারণা, এই দেবত্বের অভিজ্ঞতা তার হতে পারে। সংসারে যাঁরা মহৎ, যাঁরা সাধক, তাঁদের হয়তো হয়৷
অবনী বলল, আপনি কি দেবতা হয়ে উঠতে চান?
কতটা হতে পারি তার চেষ্টা করতে দোষ কোথায়! যদি ঈশ্বরের মমতা আমারই কল্পনা হয়, যদি বলি ঈশ্বরের চেয়ে সহিষ্ণু আর কিছু নয় তবে আমার পক্ষে আমার কল্পনার ঈশ্বরের মতো মমতাময়, সহিষ্ণু হবার চেষ্টা করতে আপত্তি কোথায়!