এতক্ষণ সে প্রায় কোনও কথাই বলেনি, সুরেশ্বর এক-আধটা কথা কী যেন বলেছিল, অবনী জবাব দিয়েছে কী না তাও মনে পড়ল না। এবার অবনী বলল, উনি এখানে কত দিন থাকলেন?
আট-ন মাস, সুরেশ্বর জবাব দিল।
অনেক বেশি বলে মনে হয়–। অবনীর গলার স্বর উদাস।
বর্ষার মুখে এসেছিল।
বসন্তের শুরুতে চলে গেল– অবনী হঠাৎ কেমন হালকা করে বলবার চেষ্টা করল। তারপর সামান্য চুপ করে থেকে বলল, আসার দিনের কথাটা আমার মনে আছে।
সুরেশ্বর সহজ গলায় বলল, হ্যাঁ..আপনি আমাদের লাটুঠার মোড় থেকে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
অবনী চুপ করে থাকতে থাকতে যেন হেসে বলল, সেবার আপনার আশ্রমে, এবারে স্টেশনে।
সুরেশ্বরও যেন হাসল একটু।
গাড়িটা ধীর-গতি করে অবনী এবার স্বাভাবিকভাবে একটা সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ আর কোনও কথা বলল না, দু-চার মুখ ধোঁয়া খেল। বলল, আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে যদি কিছু মনে না করেন…
মনে করার কী আছে!
না, তবু অবনী ইতস্তত করে বলল, হয়তো আপনার ব্যক্তিগত বলে মনে হতে পারে…
আপনি কী জানতে চান আমি তো জানি না।
অবনী সরাসরি কিছু বলল না। ভাবছিল। সুরেশ্বর সম্পর্কে তার আগ্রহ এবং কৌতূহল নানা কারণে বেড়েছে; অবনী অনেক কিছুই জানতে আগ্রহ বোধ করে, যেমন সুরেশ্বরের মার কথা, কিংবা বাবার; জানতে ইচ্ছে করে সুরেশ্বরের এই জীবনের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক আছে কিনা! হৈমন্তীর সঙ্গে সুরেশ্বরের সম্পর্কের কোথায় শুরু, আর কেনই বা শেষ–এও তার কৌতূহলের বিষয়। নির্বোধের মতন, অথবা ঝোঁকের মাথায় সুরেশ্বর হৈমন্তীকে নিজের মর্জি মতো চালাতে চেয়েছিল বলেও মনে হয় না। সুরেশ্বর কী চেয়েছিল? কী আশা করেছিল? কেন এনেছিল? মনে হয় না, এসবই একটা সাধারণ ভুল। অবনীর নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ সত্ত্বেও সে এই ধরনের কথা তুলল না। তার মনে হল না, সুরেশ্বর তার ব্যক্তিগত ও নিজস্ব এইসব কথা পছন্দ করবে।
শেষ পর্যন্ত অবনী বলল, আজ আপনার আফশোস হচ্ছে না?
সুরেশ্বর সামান্য মুখ ফেরাল, অবনীকে দেখল। আফশোস! ..
অবনী বুঝল না সুরেশ্বর কথাটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবে কী না। বলল, আমি ভেবেছিলাম, মনে মনে আপনি আফশোস করবেন।
হেম ফিরে গেল বলে—
অবনী কিছু বলল না।
সুরেশ্বর সামান্য সময় নীরব থাকল, তারপর বলল, হেমকে আমি নিজের স্বার্থে এনেছিলাম, স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলে মানুষের লাগে।
আমি ঠিক স্বার্থের কথা বলছি না– অবনী বলল, স্বার্থ ছাড়াও কিছু থাকতে পারে। …হারাবার আফশোসও মানুষের থাকে।
সুরেশ্বর যেন কয়েক মুহূর্ত ভাবল, বলল, কী জানি, তেমন কোনও আফশোস আমার নেই। বলে সামান্য থেমে আবার বলল, হেমকে এখানে এনে আমি কিছুই দিতে পারলাম না সে-দুঃখ আমার থাকবে।
অবনী কথাটা কিছু বুঝল, কিছু বুঝল না। সুরেশ্বর বোধহয় মনে করে না হৈমন্তী তার প্রাপ্ত বস্তু ছিল, কিংবা প্রাপ্য বস্তু; হারাবার প্রশ্নটাও তাই তার কাছে অবান্তর।
অবনী কী ভেবে বলল, আপনি এরকম যে কেন করলেন আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না। ওঁকে তো আপনি চিনতেন, জানতেন, বুঝতেন…। অবনীর গলার স্বরে আন্তরিকতা ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিছু সময় আর কোনও কথা বলল না, পরে বলল, আপনি নিশ্চয় যা দিয়েছিলেন তা ফেরত চাননি।
হেমকে আমি কিছু দিইনি।
এক সময়ে ওঁর অসুখে যথেষ্ট করেছিলেন।
সুরেশ্বর অবাক হল। কে বলল?
উনিই বলেছেন।
সুরেশ্বর যেন বিব্রত বোধ করল। তুচ্ছ কথাটা হেম কেন এমন করে মনে রেখেছে আমি জানি না।
কৃতজ্ঞতা।
সুরেশ্বর ব্যথিত হল। বলল, আমি কী সেজন্যে তাকে এখানে আনতে পারি!
আমারও মনে হয় না এসব হিসেব আপনি বোঝেন।
সুরেশ্বর অন্যমনস্ক, কিছু ভাবছিল। বলল, অসুখের সময় হেমের বয়স ছিল অল্প। সে ওই বয়সে সংসারের এমন জায়গায় গিয়ে পড়েছিল যেখানে শোক, দুঃখ, কষ্ট, অসহায়তা। আমার মনে হত, হেম দুঃখকে নিজের জীবন দিয়ে দিনে দিনে চিনে নিচ্ছে। ওর তখন কত মমতা দেখেছি, কত ভালবাসা দেখেছি। ভেবেছিলাম, ওর মধ্যে দুঃখের বোধ হয়েছে। ওর তা হয়নি। আমারও নয়। তারপর ও সুস্থ হল, ঘরে এসে বাইরের দুঃখু ভুলে গেল। …আমিও হয়তো ভুলে যেতাম, কিন্তু আর-একজন এল, যে আমায় ভুলতে দিল না; সে আমায় কোথায় যে হাত ধরে নিয়ে গেল…থাকল না..আমায় রেখে চলে গেল… সুরেশ্বরের গলা ভরে এসেছিল, যেন কণ্ঠ নয় তার হৃদয় কিছু বলছে।
অবনী মুখ ঘুরিয়ে সুরেশ্বরকে দেখছিল, দেখতে দেখতে সে অনুভব করল কোনও অদ্ভুত বিষণ্ণতা তাকে গ্রাস করছে। এ বিষণ্ণতা তার নয়, তবু কোনও আশ্চর্য যাদুমন্ত্রে যেন সে এই সম্মোহনের মধ্যে প্রবেশ করেছে। অন্যমনস্কভাবে অবনী গাড়ি প্রায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছিল, এবং এত ধীরে ধীরে গাড়িটা যাচ্ছিল যেন এই নিস্তব্ধ প্রান্তরে কোনও পশুর মতন হাঁটছে, তার কোনও গন্তব্য নেই, আশ্রয় নেই।
গাড়িটা দাঁড় করাল অবনী। অন্যমনস্কতা এবং এই সম্মোহন সে নষ্ট করার চেষ্টা করল। চারপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। তারা অনেকটা পথ চলে এসেছে, ডান দিকে একটা বটগাছের তলায় ঢিবির মতন চুনকাম করা মন্দির, তার গা বেয়ে বাঁশের মাথায় লাল শালু উড়ছে, কোথাও জনমানব নেই, ওপাশে ঝোপে ঝোপে জোনাকি উড়ছে, পাশে বুঝি খালের নালা, জ্যোৎস্নাজোড়া প্রান্তরের বুকে নালাটি ক্ষতের দাগ হয়ে পড়ে আছে। মাঠে মাঠে বাতাস ছুটছিল, সি সি শব্দ হচ্ছিল।