কী যে ছেলেমানুষি… হৈমন্তী হাসবার চেষ্টা করল। আবার তো দেখা হচ্ছে..
কী জানি!
বাঃ! কী জানি কি! .. হৈমন্তী আরও ঝুঁকে পড়ল, তার বুক জানলায়, ডান হাতটা হঠাৎ অবনীর হাতের ওপর এসে পড়ল, যেন কোনও কান্না চাপার চেষ্টা করছে মুখ লুকিয়ে, অবনীর হাতের ওপর হাত রেখে বুক নুইয়ে মাথা নিচু করল। তার কপাল এবং চুল দেখা যাচ্ছিল। হৈমন্তী বলল, কলকাতায় আমাদের বাড়িতে উঠবে। উঠবে না?
অবনী বলল, উঠব।
তারপর আর কিছু না, হৈমন্তী মুখ ওঠাবার পর হাত সরিয়ে নিল, কামরাটা পলকে অনেকখানি এগিয়ে গেল। তারপর অন্ধকার, জানলায় ছায়ার মতন হৈমন্তী ছিল একটু, পর মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। আর কিছু দেখা গেল না। রেল লাইনের চাকায় শব্দ, দু-এক ঝলক আলল, দেখতে দেখতে গাড়ি প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে গেল, গার্ডের গাড়ির পিছনের লাল আলো, ক্রমশ সেই আলো নিষ্প্রভ, ছোট ও শেষে বিন্দুবৎ হয়ে অদৃশ্য হল। অন্ধকারে চাঁদ উঠেছে, ঝাপসা চাঁদের আলোয় সামনের বন অসাড় ঘুমন্ত দেখাচ্ছিল, গাড়িটা তার মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, অবনী আর দেখতে পেল না।
কয়েক মুহূর্ত বনের দিকে তাকিয়ে অবনী নিশ্বাস ফেলল, হৈমন্তীর উষ্ণ হাত ও বুকের স্পর্শ অনুভব করার জন্যে তার ডান হাতটা মুখের সামনে তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে ফিরতে লাগল।
প্ল্যটফর্ম ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল, দু-একজন রেলবাবু ছাড়া বড় কেউ ছিল না; সুরেশ্বর, বিজলীবাবু এবং অবনী ফিরছিল। ওভারব্রিজের সিঁড়ি ওঠার সময় বিজলীবাবু কী যেন বললেন, সুরেশ্বর সংক্ষেপে জবাব দিল। অবনী কিছু বলল না। কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দও অনেকক্ষণ শোনা গেল না।
ওভারব্রিজ পেরিয়ে এসে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিজলীবাবু সুরেশ্বরকে বললেন, আজকের রাতটুকু এখানে কাটিয়ে গেলেও পারতেন, মহারাজ।
সুরেশ্বর মাথা নাড়ল। না, বিজলীবাবু।
তবে চলুন; লাস্ট বাসটা আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে।
অবনী এতক্ষণে যেন কথাটা খেয়াল করতে পারল। বলল, বাস কেন! আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসব।
না, আবার আপনি কেন যাবেন? সুরেশ্বর আপত্তি জানাল।
চলুন; রাস্তা সামান্য; আমার কোনও কষ্ট হবে না।
কবার আর যাবেন আসবেন? বিকেলে গিয়েছিলেন, এখন আবার…
ও কিছু না। চার পাঁচ মাইল রাস্তা যেতে অসুবিধের কী আছে…
অবনীর গলার স্বর থেকে মনে হচ্ছিল তার পক্ষে যেন এখন এই যাওয়াটুকুর প্রয়োজন আছে। সুরেশ্বর অবনীকে লক্ষ করল। ওভারব্রিজের নীচে মোসাফিরখানার দিকে অবনীর জিপ দাঁড় করানো আছে। অবনী গাড়ির দিকে পা বাড়াল।
বিজলিবাবুর দিকে তাকাল সুরেশ্বর, যাবেন নাকি?
না, মহারাজ, আমার উপায় নেই। অফিসে ক্যাশ ফেলে এসেছি… বিজলীবাবু হেসে বললেন, ক্যাশ তুলতে হবে, কয়েকটা খুচরো কাজও আছে। মিত্তিরসাহেব আপনাকে বরং পৌঁছে দিয়ে আসুন।
সুরেশ্বর বলল, তা হলে আজ চলি, বিজলীবাবু।
আসুন। ..আমি একদিন যাচ্ছি। …মিত্তিরসাহেব, আমি এগোই।
বিজলীবাবু চলে গেলেন। সুরেশ্বর অবনীর পাশে পাশে হেঁটে গাড়ির কাছে এল। অবনী গাড়িতে ওঠার আগে একটা সিগারেট ধরাল।
কটা বাজল? সুরেশ্বর শুধোল।
অবনী ঘড়ি দেখল, প্রায় আট।
সুরেশ্বর পাশ দিয়ে উঠে বসল, অবনী উঠে পড়েছে।
গাড়িতে স্টার্ট দিল অবনী; হেডলাইট জ্বালল, তারপর সামনের দিকে সামান্য এগিয়ে বাঁ হাতে রাস্তা ধরল।
স্টেশনের এই দিকটার আলো, বাজার, মানুষজন, দোকানপসার, শিবমন্দির যেন কয়েক পলকের মধ্যে পেরিয়ে হঠাৎ গাড়িটাকে নির্জনতা ও অন্ধকারের মধ্যে এনে ফেলল অবনী; গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে থানা এল, থানার পাশে বুঝি রামলীলা বসেছে, আলো জ্বলছে মাঠে, অল্প একটু শামিয়ানা, থানা ছাড়িয়ে একেবারে ফাঁকায় এসে পড়ল। লোকালয় বলে আর কিছু নেই, ফাঁকা নিস্তব্ধ মাঠ, ঝিঁঝির ডাক, জ্যোৎস্না ধরেছে মাঠেঘাটে, বসন্তের বাতাস দিচ্ছিল, বাতাসে শব্দ হচ্ছিল ঈষৎ।
অবনী এতক্ষণ কেমন একটা আচ্ছন্নতার মধ্যে ছিল। ফাঁকায়, নির্জনে এবং স্তব্ধতার মধ্যে এসে ক্রমশ যেন ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার মতন তার সেই ঘোর কেটে আসছিল। চোখ চেয়ে অবনী পথঘাট মাঠ এবার যেন দেখতে পাচ্ছিল, সামান্য আগেও তার কোনও খেয়াল ছিল না, অভ্যাস এবং অনেকটা যেন যন্ত্রের মতন সে গাড়িটাকে চালিয়ে এনেছে। এতটা অন্যমনস্ক ভাবে গাড়ি চালানোর বিপদ হতে পারত। আশ্চর্য, হৈমন্তীর গাড়ি প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যাবার পর সে এতক্ষণ কী করেছে, কী বলেছে কিছুই তার স্পষ্ট করে মনে পড়ছিল না–যেন যা ঘটেছে সবটাই কোনও ঘোরের মধ্যে, স্বাভাবিক কোনও চেতনা ছিল না। বিস্মৃত স্বপ্নের মতন তার সামান্য দাগ মাত্র লেগে আছে। অবনী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল; কিছুক্ষণ মনে মনে হৈমন্তীকে দেখল: ট্রেনের খোলা জানলায় মুখ রেখে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে আছে, কয়লার গুঁড়ো জমছে মুখে।
সামনের রাস্তা থেকে লাফিয়ে এক ঝলক আলো উঠে এল। উলটো দিক থেকে গাড়ি আসছে। অবনী স্বাভাবিক দৃষ্টিতে পথঘাট লক্ষ করার চেষ্টা করল, সতর্ক হল। ঢালু থেকে উঁচুতে উঠেছিল, এবার মোটামুটি সমভূমি দিয়ে আসছে। কাছাকাছি এসে গেল। অবনী গাড়ির হেডলাইট নিবিয়ে পথের পাশে সরে গেল সামান্য, একটা মাল লরি, পাশ কাটিয়ে চলে গেল পলকে! হেডলাইট জ্বালিয়ে আবার মাঝরাস্তায় গাড়ি আনল অবনী।