.
সুরেশ্বর বলল, একটা গরম কিছু নাওনি?
হৈমন্তী অন্যদিকে তাকিয়ে মাথা হেলিয়ে বলল, নিয়েছি।
গাড়িতে পরে নিয়ো; রাত্তিরে ঠাণ্ডা পড়বে।
হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। এসব তুচ্ছ কথা তার ভাল লাগছিল না।
তোমার গাড়ি একেবারে ভোরে ভোরে হাওড়া পৌঁছে যাবে। গগনটা সময় মতন এসে পৌঁছতে পারলে হয়। …না হলে তোমার কোনও অসুবিধে হবে না, সঙ্গে লোক আছে, মালপত্র নামিয়ে একটু অপেক্ষা কোরো গগনের জন্যে।
হৈমন্তী দুরে তাকিয়ে থাকল: সিগন্যালের আলো দেখছিল যেন।
দেখতে দেখতে প্ল্যাটফর্মে চাঞ্চল্য বেড়ে একটা কলরব জেগেছে। বনের দিক থেকে রাত্রের বাতাস আসছে, ঠাণ্ডা, জঙ্গলের গন্ধ ভরা। স্টেশনের বাসস্ট্যান্ডের দিকে একটা গাড়ি ক্রমাগত হর্ন দিচ্ছে, কাউকে ডাকছে বোধ হয়; ওভারব্রিজের মাথায় কয়েকটা লোক ছুটছে। গাড়ি আসার দ্বিতীয় ঘণ্টি পড়ে গেল, সামনের একটা সিগন্যাল সবুজ হল।
গাড়ি এসে গেল। সুরেশ্বর বলল, চলো, গাড়ি আসছে।
হৈমন্তী ফিরতে লাগল। প্ল্যাটফর্মে কলরব বেড়ে গেছে, মালপত্র মাথায় ওঠাচ্ছে কুলিরা, সামান্য ছুটোছুটি। গাড়ি আসছে, হুইসল শোনা যাচ্ছে; ইঞ্জিনের শব্দ, হঠাৎ আলো এসে পড়ল, লাইনে শব্দ উঠছিল, চারপাশ প্রকম্পিত যেন।
সুরেশ্বর ওভারব্রিজের কাছে হঠাৎ বলল, আমি কলকাতায় চিঠি লিখে দিয়েছি, হেম। তোমায় কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবে না। সুরেশ্বর থামল, তারপর কী ভেবে আবার বলল, মাসিমাকে আমি আর-একটা কথা লিখেছি, হেম; তুমি নিশ্চয় জানতে পারবে। …সংসারে তুমি যা চাও বেশির ভাগ মানুষই তা চায়; আমি তাতে দোষ দেখি না, অবজ্ঞাও করি না। …তুমি সুখী হও হেম; শান্তি পাও।
হৈমন্তী চোখ তুলে তাকাল। তার জানতে ইচ্ছে করছিল, কী লিখেছ তুমি মাকে? কোন কথা? জানতে ইচ্ছে করলেও হৈমন্তী কিছু জিজ্ঞেস করল না; মনে হল, কথাটা এখন স্পষ্ট করে জানলে হয়তো সে অস্বস্তির মধ্যে পড়বে। ইঞ্জিনের আলো প্ল্যাটফর্ম আলোকিত করে বেঁকে লাইনের ওপর পড়ল। কেবিন পেরিয়ে গাড়িটা প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়েছে, প্ল্যাটফর্ম কাঁপছিল।
গাড়ি থামল। বিজলীবাবু যেখানে মালপত্র জড়ো করিয়ে রেখেছিলেন তার কয়েক হাত তফাতেই হৈমন্তীর কামরা। অবনী উঠে গিয়েছিল; কুলিরা মালপত্র তুলে দিল একে একে; কামরার অন্যদিকে এক অবাঙালি দম্পতি, একটি বাচ্চা; হৈমন্তীর মালপত্র গুছিয়ে রাখা হল, কিছু বুঝি লাগেজ ভ্যানে দিতে হয়েছে। বিজলীবাবু সব গোছগাছ করে দিয়ে নীচে নেমে দাঁড়ালেন; সঙ্গে যাচ্ছেন দাসবাবু, দেখাশোনা করে পাশের কোন কামরায় চলে গেলেন।
গাড়ি ছাড়তে এখনও সামান্য দেরি। পাতা বিছানায় হৈমন্তী এবার বসল, অবনী দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ, এবার নামল, নেমে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে জানলার সামনে এসে দাঁড়াল।
হৈমন্তী বলল, ওরা চলে গেছে?
কারা?
কুলিরা।
অবনী এপাশ ওপাশ দেখল। যায়নি। আছে। …কেন?
ওদের কটা টাকা দেব। হৈমন্তী ব্যাগ খুলে টাকা বের করতে লাগল।
অবনী একটা কুলিকে ডাকল। কুলিটা কাছে এলে হৈমন্তী তার হাতে একটা দশ টাকার নোট দিল, বলল, তোমরা সকলে ভাগ করে নিয়ো। কুলিটা হাত পেতে টাকা নিয়ে খুশি হয়ে চলে গেল, যাবার আগে কপালে হাত ঠেকাল।
অবনী এবার ঠাট্টাচ্ছলে বলল, আমার ভাগ্যেও কিছু বকশিশ আছে নাকি?
হৈমন্তী হাসবার চেষ্টা করল। পারল না।
সুরেশ্বর এগিয়ে আসছিল; বিজলীবাবুও আসছেন। গাড়ি ছাড়ার আর বুঝি দেরি নেই। অবনী ইঞ্জিনের দিকে তাকাল: সিগন্যাল সবুজ হয়েছে।
সুরেশ্বর জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। কামরাটা দেখল একবার। ভালই হয়েছে, সঙ্গী পেয়ে গেছ। ওঁরা কতদূর যাবেন?
জানি না, হৈমন্তী বলল।
বিজলীবাবু পাশে এসে গেছেন, ওরাও কলকাতা যাচ্ছে।
তবে তো ভালই, সুরেশ্বর বলল। আর খানিকটা পরে জানলাগুলো ফেলে দিও। রাতের ঠাণ্ডা খেয়ো না।
দরজাটা উনি ভেতর থেকে লক করে দেবেন–আমি বলেছি– বিজলীবাবু অবাঙালি ভদ্রলোককে ইঙ্গিতে দেখিয়ে সুরেশ্বরকে বললেন। আর কোনও ঝামেলা নেই। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পৌঁছে যাবেন। শেষের কথাগুলো হৈমন্তীকে বলা।
গায়ে গরম কিছু একটা দিয়ে নিয়ো, সুরেশ্বর বলল।
হৈমন্তী মাথা নোয়াল, পরে দেব।
গার্ডের সিটি বাজল।
আচ্ছা দিদি, গাড়ি ছাড়ল– বিজলীবাবু বিদায় জানিয়ে হাসলেন, আবার দেখা হবে– বলতে বলতে তিনি দুহাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার জানালেন।
হৈমন্তী নমস্কার করল। সরসীদিকে নিয়ে আসবেন একবার কলকাতায়। তাঁকে আমার কথা বলবেন। দিদিকে নমস্কার দেবেন।
বিজলীবাবু হাসিমুখে দু পা পিছিয়ে এলেন।
সুরেশ্বর গাঢ় মৃদু গলায় বলল, কলকাতায় পৌঁছে চিঠি দিয়ো…
হৈমন্তী আস্তে করে মাথা হেলাল। দেবে, চিঠি দেবে পৌঁছে। অনুচ্চ স্বরে বলল, তোমার ওখানে এখনও অসুখ-বিসুখ, সাবধানে থেকো।
ইঞ্জিনের হুইসল বাজল আচমকা, তারপর গাড়ি নড়ে উঠল। বিজলীবাবু খানিকটা পিছিয়ে গেলেন, সুরেশ্বর সরে দাঁড়াল। গাড়ি চলতে শুরু করেছে, অবনী পাশে পাশে হাঁটতে লাগল, হৈমন্তীর মাথা সামান্য ঝুঁকে পড়েছে, চুল এবং চিবুকের একপাশে আলো, প্ল্যাটফর্মের একটা আলো ডিঙিয়ে গেল কামরাটা, সামান্য অন্ধকার। অবনী অন্ধকারে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে জানলা ধরে ফেলল।
চলি…
খুব খারাপ লাগছে।