অবনী বলল, কলকাতায় গিয়ে আমাকে একবার উকিল-টুকিল, কোর্টকাছারি করতে হবে।
হৈমন্তী বুঝল না, হেসে বলল, সম্পত্তিটম্পত্তি আছে নাকি আপনার?
না; সম্পত্তি নেই। …সম্পত্তি থাকার মতন সম্ভ্রান্ত আমি নই।
সম্পত্তি না থাকলে সম্ভ্রান্ত হয় না? হৈমন্তী অন্তরঙ্গ সুরে ঠাট্টা করল।
অবনী দুপলক যেন দেখল হৈমন্তীকে, তারপর বলল, না, আমি সম্ভ্রান্ত নই। রেসপেকটিবিলিটি আমার নেই। …যাক গে, সেটা পরের কথা, পরে শুনবেন। ..কলকাতায় আমার মেয়ে আছে। অবনী বলল, গলার স্বর কাঁপল না।
হৈমন্তী নির্বাক, নিশ্চল; ঘাড় ফিরিয়ে যেভাবে চোখ তুলে তাকিয়ে ছিল সেই ভাবেই তাকিয়ে থাকল, যেন নিশ্বাস নিচ্ছে না, বিস্ময় আছে কি না তাও বোঝা যায় না।
অবনীর মনে হল, তার বুকের মধ্যে থেকে কোনও যন্ত্রণা উঠে আসতে চাইছে, গলার কাছটায় কান্নার মতন লাগছে, জীবনের কোনও ব্যর্থতা বুঝি সিসের মতন ভার হয়ে আছে হৃদয়ে। মুখ হাঁ করে শ্বাস নিল অবনী, মাথার দুপাশে কপালের কাছে বরাবর জ্বালা করছিল। চোখে যেন কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। বলল, আমার জীবনে অপছন্দ করার মতন অনেক কিছু আছে; সেসব হয়তো আপনার ভাল লাগবে না। …আমার স্ত্রী ছিল, তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই, থাকবে না। মেয়েটাকে আমি নিজের কাছে আনব। …কলকাতায় গিয়ে কিছু কাজ বাকি আছে। দেখি কী হয়…!
হৈমন্তী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। বাতাসে তার আলগা আঁচলের অনেকটা উড়ে অবনীর গায়ে লাগছিল। কখন যেন চাঁদের আলো ফুটে উঠেছিল।
এক সময় অবনী বলল, রাত হয়ে যাবে, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। …একটু দাঁড়ান, আমি আসছি।
.
অবনী ফিরে এসে দেখল, হৈমন্তী কদম গাছের কাছে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। গাড়িটা কলাবাগানের দিকে দাঁড় করান ছিল। গাড়ি ঘুরিয়ে হৈমন্তীর সামনে এসে অবনী ডাকল, আসুন।
হৈমন্তী উঠে এল।
.
৩৩.
আপ প্ল্যাটফর্মে স্টেশনের অফিসঘরের কাছ থেকে গাড়ি আসার ঘন্টি বাজল, প্রথম ঘণ্টি; গাড়ি আসতে এখনও সামান্য দেরি।
ডাউন প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের ভিড় জমে উঠেছিল; এখনও লোক আসছে ওভারব্রিজ দিয়ে। শেডের তলায় ভিড়টা বেশি: টিনের সুটকেস, কাঠের বাক্স, বোঁচকা কুঁচকি, বস্তা, লাঠিসোঁটা আগলে দেহাতিরা বসে আছে; একপাশে কিছু নিত্যযাত্রীর জটলা; বিড়ির ধোঁয়া, কাশি, বিচিত্র এক গুঞ্জন ভাসছে। চাঅলা, পানঅলা হেঁকে যাচ্ছিল। গাড়ি আসার প্রথম ঘণ্টিতে চাঞ্চল্য জাগল।
ওভারব্রিজের নীচে, ফাঁকায়, হৈমন্তীর মালপত্র জড়ো করা। সামান্য তফাতে ব্রেকভ্যানে তোলার জন্যে রেলকুলিরা সবজির ঝুড়ি, আলুর বস্তা, এটা-ওটা জমা করছিল। বিজলীবাবু বাস-অফিসের কয়েকটা কুলিকে নিয়ে হৈমন্তীর মালপত্রের কাছে দাঁড়িয়ে চেনাশোনা লোকের সঙ্গে গল্প করছিলেন। অবনী কাছাকাছি জায়গায় পায়চারি করছিল।
সামান্য তফাতে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় সিমেন্টের বেঞ্চিতে হৈমন্তী এতক্ষণ বসেছিল তারপর যেন অধৈর্য হয়ে বা বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে করতে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরছিল।
সুরেশ্বর ফাঁকায় দাঁড়িয়ে পরিচিত এক বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিল অনেকক্ষণ, গাড়ির প্রথম ঘণ্টি বেজে যাবার পর আলাপ চুকিয়ে এপাশে এল, এসে হৈমন্তীর কাছাকাছি দাঁড়াল।
আপ ডাউন প্ল্যাটফর্মের মধ্যে রেল লাইনে কোথাও মালগাড়ি দাঁড়িয়ে নেই। ওপারের আলো এপারে আসছিল, এপারে আলো কম। ওপাশটা ফাঁকা; টি-স্টলের কাছে দু-একজন দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে; মাল-গুদোমের দিক থেকে আলকাতরা আর চুনের গন্ধ ভেসে আসছিল মাঝে মাঝে, বাতাস এলোমেলো।
হৈমন্তীর কাছাকাছি এসে, পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ্বর বলল, তোমার গাড়ি আজ মিনিট কুড়ি পঁচিশ দেরি করল। বলে কী ভেবে আবার বলল, যার সঙ্গে কথা বলছিলাম, উনি এখানকার স্টেশন মাস্টার। যেন স্টেশন মাস্টারের কাছ থেকেই গাড়ির খবরটা এনেছে সুরেশ্বর।
হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। গাড়ি আসতে দেরি করছে এটা সে জানে। যখন বসেছিল তখন অবনী এসে বলেছে, বিজলীবাবুও একবার বলে গেছেন। আজ, এখন, স্টেশনে আসার পর সে দেখছে তার বেশির ভাগ সময় একা একা কাটল, হয় একা একা, না হয় অতি তুচ্ছ কথায়। অবনী তার সামনে বা পাশে বেশিক্ষণ থাকছিল না; কখনও আসছিল, বসছিল একটু বা দাঁড়িয়ে থাকছিল, দু-চারটে সাধারণ কথা বলল, আবার চলে গেল ওপাশে; সুরেশ্বরও বার কয়েক কাছে এসেছিল, কথা বলেছিল, চেনাশোনা লোক দেখে উঠে গিয়েছিল আবার। ট্রেনে ওঠার পর হৈমন্তী একা, সারাটা পথ সে একা, এই শেষ সময়টুকু তার একা থাকতে ইচ্ছে ছিল না। অথচ অনেকটা সময় একা থাকতে হল।
হাঁটতে হাঁটতে ওভারব্রিজের কাছাকাছি পর্যন্ত এল, দাঁড়াল হৈমন্তী। অবনী মুখের সিগারেট থেকে অন্য একটা সিগারেট ধরাচ্ছে, বিজলীবাবু কুলিদের কী বুঝিয়ে বলছেন, শেডের তলায় যাত্রীরা ওঠাওঠি শুরু করেছে। কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থেকে হৈমন্তী আবার মুখ ফেরাল, ফিরিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল।
কয়েক-পা হেঁটে এসে হৈমন্তী দাঁড়াল। এখানটা আধো-অন্ধকার, পাশে প্ল্যাটফর্মের নীচে রেল লাইনের পাথরকুচি কোথাও কোথাও ছোট ছোট ঢিবির মতন পড়ে আছে। থোকা থোকা ছায়ার ফুল যেন। অন্ধকারে কৃষ্ণচূড়ার গাছটা বাতাসে কাঁপছিল। আজ এখনও চাঁদ ওঠেনি, ওঠার সময় হয়ে এল।