হৈমন্তী নিঃসাড় হয়ে বসে ছিল, স্থির, বাগানের দিকে চোখ, একটা হাত গলার কাছে, গালে আঙুলের ডগা ছুঁয়ে রয়েছে। মুখটি এখনও যেন আঁচে ঝলসানো।
কিছু সময় এইভাবে কাটল, কেউ কোনও কথা বলল না। গুমট লাগছিল। অবনী আড়ষ্ট, বিব্রত; হৈমন্তী নীরব, স্থির, অসাড়। শেষ পর্যন্ত অবনী মৃদু গলায় বলল, আমারই দোষ; আমি আপনাকে অকারণে অসন্তুষ্ট করলাম। যাক গে, যেতে দিন…। বলে সামান্য থেমে, যেন হৈমন্তীর কোনও ক্ষোভ বা গ্লানি মুছে দেবার চেষ্টা করছে বলল, আমার ধারণা, আপনি আপনার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন, এর বেশি করা যায় না। জগতে সবাইকে সুরেশ্বর হতে হবে এমন কথা নেই।
হৈমন্তী কথা বলল না, কিন্তু দীর্ঘ নিশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল। সামান্য নড়ল, গালের কাছ থেকে হাতটা নামাল।
অবনী অন্যমনস্কভাবে আবার সিগারেট ধরাল। বলল, আপনি কি এখনও রাগ করে আছেন? বলার মধ্যে যেন অনুশোচনার এবং সঙ্কোচের ভাব ছিল।
হৈমন্তী মাথা নাড়াল। না। আপনার ওপর রাগ করব কেন!
কথাটা আমার তোলা উচিত হয়নি।
তুলে ভালই করেছেন। হৈমন্তী যেন বুকের বোঝা হালকা করার মতন নিশ্বাস ফেলল, পিঠ একটু টান করে বসল, শেষে আবার বলল, আমার দিক থেকে আমি হালকা হলাম।
অবশেষে অবনী উঠল, বলল, চলুন, খানিকটা পায়চারি করা যাক বাগানে, বেশ বাতাস দিচ্ছে…
হৈমন্তীও উঠল।
বাগানে এসে সামান্য আগুপিছু হয়ে দুজনে পায়চারি করতে লাগল। সন্ধে হয়ে গেছে, বাতাস চঞ্চল ও স্নিগ্ধ। পাতার গন্ধ উঠছিল, বিকেলে বাগানে জল দিয়েছে মালি, মাটির একটা গন্ধ ছিল। জবাগাছের ডাল ছাঁটা হয়েছে সদ্য, লাল টিপফুলের গাছটা ফুলে ভরা, থোকা থোকা গাঁদা এক পাশে, কিছু শুকনো মুরশুমি ফুল।
এক সময় পাশাপাশি হয়ে হাঁটতে লাগল দুজনে মন্থর পায়ে।
অবনী বলল, মানুষের মনের কিছু ঠিক নেই। কথাটা সে আচমকা বলল।
হৈমন্তী বুঝতে পারল না, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।
অবনী হাসার চেষ্টা করে বলল, আপনি যতদিন এখানে থাকলেন ততদিন মনে হত, অকারণে কেন পড়ে আছেন; খারাপই লাগত। এখন চলে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে–বেশ তো ছিলেন।
হৈমন্তীর মন অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছিল। ম্লান হেসে জবাব দিল, তাই নাকি! .এদিকে তো আমায় তাড়াবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
যাবার সময় এ-রকম একটা বদনাম রটিয়ে যাচ্ছেন! অবনী হাসল।
ছি ছি, বদনাম রটাব কেন! আপনার সুনামই করব। হৈমন্তীর গায়ের আঁচল আলগা করে দিল, হাসল, বাতাসে সিল্কের শাড়ির আঁচল কাঁপছিল। পরে বলল, আমাকে অকৃতজ্ঞ ভাবলে সত্যিই আমার কষ্ট হয়। আপনাদের কাছ থেকে আমি কমটা কী পেলাম! …সরসীদি আজ বলছিলেন, এখান থেকে চলে যেতে আমার খারাপ লাগছে না? বললাম, খুব খারাপ। সত্যি, আমার খারাপ লাগছে।
হৈমন্তীর গলায় বেদনা এবং দুঃখের কেমন এক গাঢ়তা ছিল। অবনী এই বেদনা অনুভব করছিল। বলল, আমরা বোধহয় প্রায়ই আপনার কথা বলব।
হৈমন্তী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল; স্টেশনের দিকে একটা মালগাড়ি আসছে বোধহয়–গুমগুম শব্দ উঠছে। শব্দটা বুকে লাগছিল হৈমন্তীর।
অল্প চুপচাপ থেকে অবনী বলল, মনে করে রাখার মতন সু-দিন আমাদের জীবনে বড় আসে না। অন্তত আমার জীবনে আসেনি। আপনি এসেছিলেন, আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, বন্ধুত্ব হয়েছিল এ আমার ভাগ্য। আমি মনে রাখব।
বাতাসে হৈমন্তীর এলো আঁচল উড়ে অবনীর হাতে লাগছিল। এখনও আকাশে চাঁদ ওঠেনি, উঠে আসছে, অন্ধকার ম্লান হয়ে এল, মালগাড়ির গুমগুম শব্দটা আরও স্পষ্ট, যেন স্টেশনের কাছাকাছি চলে এসেছে, ফুলগাছের মাটির সামান্য সোঁদা ভিজে ভিজে গন্ধ, কোনও ফুলের মৃদু সুবাস ভাসছে বাতাসে। হৈমন্তী দাঁড়াল।
অবনী সিগারেটের টুকরোটা দূরে ছুঁড়ে দিল। হৈমন্তীর ডিমের মতন মসৃণ গড়নের মুখ, টোল-তোলা নরম থুতনি, টানা টানা চোখের পাতা, সুন্দর গভীর নির্মল দুটি চোখ, মাথার পাতলা ঈষৎ রুক্ষ রেশমের মতন চুলের এবং তার স্থির, অল্প শিথিল, অবনত দেহের চারপাশে একটি অব্যক্ত মায়া যেন সৃষ্টি হয়েছিল। অবনীর মনে হল, তার জীবনে এ যেন এক অন্য মুহূর্ত, যা আগে কখনও আসেনি ভবিষ্যতেও আসবে না। সম্মোহিতের মতন হৃদয়ের কোনও আশ্চর্য তাড়নায় সে হৈমন্তীর দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকল।
হৈমন্তী এক সময় মুখ তুলল, তুলে অবনীকে দেখল।
মনে রাখার মতন আমারও কিছু থাকল, হৈমন্তী অস্পষ্ট গলায় বলল।
কিছুক্ষণ আর কোনও কথা হল না, দুজনেই নীরব, মালগাড়িটা এসে চলে গেল, তবু তার কম্পন যেন এখানের মাটিতে। বুক কাঁপছিল হৈমন্তীর।
কোনও রকমে নিজেকে সংযত করে হৈমন্তী বলল, আপনি কবে কলকাতায় আসছেন?
অবনী সামান্য সচেতন হল। আসছে মাসে।
কেন যাচ্ছেন তা তো বললেন না? …
অবনী মুহূর্ত কয় ভাবল, বলল, বলব। …আপনাকে আমার বলা উচিত।
হৈমন্তী বুঝতে পারল না, তাকিয়ে থাকল।
অবনী ভেবে দেখেছিল তার যদি কোনও প্রত্যাশা থাকে, যদি প্রত্যাশা অপূর্ণও থাকে তবু কথাটা তার বলা দরকার। হৈমন্তী তাকে যতটুকু জানে, যেটুকু চিনেছে তার বেশি চেনা দরকার। গ্লানি এবং মনঃক্ষোভ, ভীতি এবং সঙ্কোচ রেখে লাভ নেই। হৈমন্তীর সামনে থেকে কোনওদিন নিজের লজ্জা বাঁচাবার জন্যে দুহাতে মুখ ঢেকে চলে যেতে তার ইচ্ছে হয় না। তার চেয়ে আমি যা তুমি আমায় সেই ভাবে দেখ। আমার কোনও গোপনতা আমি রাখব না, লজ্জা-গ্লানি লুকোতে গিয়ে ধিক্কারের পাত্র হতে আমার ইচ্ছে নেই। লুকোচুরি করে কী লাভ!