সঙ্গে সঙ্গে না হলেও হৈমন্তী পরে জবাব দিল, কী জানি, আমি জানি না।
অবনী কিছু ভাবছিল, বলল, তবু কী মনে হয় আপনার?
হৈমন্তীর এই প্রসঙ্গটা ভাল লাগছিল না। এখন সে আর এমন কিছু ভাবতে চায় না যাতে মন তিক্ত হয়। বলল, আমার কিছুই মনে হয় না। মানুষের নানারকম খেয়াল থাকে। কার কী খেয়াল হচ্ছে, কেন হচ্ছে আমার তা জেনে লাভ কী?
অবনী বুঝতে পারল হৈমন্তী বিরক্ত হচ্ছে। হেসে বলল, যাবার সময় আপনার মন একেবারে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার, এখানেই বা ওই খুঁতটুকু কেন রাখছেন।
খুঁত?
রাগ-টাগ, বিরক্তি।
না– হৈমন্তী মাথা নাড়ল; বলল, ছেলেমানুষের মতন রাগ করব কেন! সেবয়েস আমার নেই। আমি রাগ নিয়ে যাচ্ছি না। তা বলে আমি ভক্তি নিয়েও যাচ্ছি না। …কিন্তু আপনি যেন সুরেশ-মহারাজের মস্ত ভক্ত হয়ে যাচ্ছেন। ব্যাপার কী?
অবনী হাসল। হাসতে হাসতে বলল, আমার মতন ভক্ত সুরেশ-মহারাজও পছন্দ করবেন না।
হৈমন্তী অবনীকে লক্ষ করে দেখছিল। দেখতে দেখতে বলল, আমার কিন্তু বেশ মনে হচ্ছে। আপনার মন ওদিকে টলেছে। বলে হৈমন্তী ঠোঁট টিপে হাসল।
সরল গলায় অবনী জবাব দিল, আমি তো আপনাকে আগেও বলেছি–কোনও কোনও ব্যাপার খারাপ লাগলেও মানুষটিকে আমার এমনিতে ভালই লাগে। …
হৈমন্তী যেন কেমন অপ্রস্তুত বোধ করল; যদিও অবনী তাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না, তবু তার মনে হল অবনী যেন হৈমন্তীরও কোনওরকম মতামত চাইছে। অর্থাৎ বলতে চাইছে, মানুষটি যে ভাল একথা কি আপনি অস্বীকার করবেন? আজ যাবার সময় অবনীর কাছে সুরেশ্বর সম্পর্কে কোনও তিক্ততা প্রকাশ করে যাবার ইচ্ছে তার ছিল না। এখন পর্যন্ত সে এমন কিছু করেনি, বলেনি যাতে তার মনের পুঞ্জীভূত আক্রোশ, তার ঘৃণা, বিরক্তি, ব্যর্থতা, নৈরাশ্যের তীব্রতা ও গভীরতা অবনী জানতে পারে। অবনী যেটুকু জেনেছে সেটুকু গোপন করার মতন সংযম তার ছিল না, নেই। বাকি যা সবই চোখ চেয়ে দেখে অবনী অনুমান করেছে। তার অনুমান মিথ্যে নয় এইমাত্র।
হৈমন্তী অপ্রস্তুত ভাবটা কাটাবার জন্যে হেসে বলল, আপনাদের সুরেশ-মহারাজকে খারাপ বলবে কে! বলে একটু থেমে আবার বলল, দেবতুল্য ব্যক্তি..
ঠাট্টা করছেন?
না না, সত্যি। …আপনারা নিঃস্বার্থে ভাল বলেন, আর আমাদের তো স্বার্থ ছিল।
স্বার্থ?
স্বার্থ– হৈমন্তী মাথা নোয়াল আস্তে করে, বলল, আমাদের স্বার্থ ছিল। এক সময়ে আমাদের জন্যে অনেকে করেছে।
অবনী নীরব থাকল। সে সুরেশ্বর সম্পর্কে কিছু জানতে চেয়েছিল মাত্র, তার বেশি নয়। অথচ যেন মনে হচ্ছে হৈমন্তীকে সে অপ্রসন্ন ও বিরক্ত করে তুলেছে। অপ্রীতিকর প্রসঙ্গটা চাপা দেবার জন্যে অবনী ব্যস্ত হল। ভুল করে বোকার মতন সুরেশ্বরের কথা সে কেন তুলল! বরং অবনী মনে মনে যে কথা বলার জন্যে আজ ব্যগ্র, উৎকণ্ঠিত, যা বলার জন্যে সে কাতর, সেই নিজের কথা কেন বলছে না! …তবে কি, অবনীর মুহূর্তের জন্যে সন্দেহ হল, হৈমন্তীকে সে পরীক্ষা করছে? সুরেশ্বর সম্পর্কে হৈমন্তীর কোথাও কোনও দুর্বলতা আছে কী না দেখছে? অবনী অস্বস্তি বোধ করল। যেন কিছুই নয়, কোনও গুরুতর বিষয়ে তারা কথা বলছে না–এইরকম ভঙ্গিতে প্রসঙ্গটা পালটাবার জন্যে অবনী হালকা করে বলল, যেতে দিন। তেমনভাবে দেখতে গেলে জগতে সবই স্বার্থ। আপনি যে এখানে এসেছিলেন, এটাও ওঁর স্বার্থ।
ওর স্বার্থ বই কি! আমার কিছু নয়, হৈমন্তী বলল। তবু, কোনওদিন, বলা তো যায় না–হয়তো আমাদের স্বার্থের কথাও জানতে পারবেন। তখন হয়তো মনে হবে আমরা–অন্তত আমি খুব অকৃতজ্ঞ।
অবনী হৈমন্তীর গলার স্বর শুনে বুঝতে পারছিল যে কোনও কারণেই হোক সে উত্তেজিত এবং অধৈর্য হয়ে উঠেছে। অবনী বাধা দেবার জন্যে কিছু বলতে যাচ্ছিল, বলতে পারল না, হৈমন্তী তার বাধায় কান দিল না।
হৈমন্তী বলল, আমাদের সমস্ত সংসার ওর কাছে কৃতজ্ঞ। …ওর দয়ায় আমি বেঁচেছি। হৈমন্তী ঝোঁকের মাথায় যেন হঠাৎ গোপনীয় কিছু প্রকাশ করছে, প্রকাশ করতে তার কুণ্ঠা নেই, দীনতা নেই; বলল, আমার তখন বয়স কম, সংসারের অবস্থাও তেমন ভাল না আমাদের, আমার অসুখ করল। তখন ও করেছে, ছুটোছুটি, ডাক্তার-হাসপাতাল; বাইরে টিবি হাসপাতালে পড়েছিলাম বছর দেড়েক। তারপরেও ওর যত্ন-উত্ন পেয়েছি। …আমার জন্যে টাকা পয়সা, সময় কম যায়নি ওর। এই দয়ার জন্যে আমরা আপনাদের সুরেশ-মহারাজের কাছে কৃতজ্ঞ।
অবনী কল্পনাও করেনি, সামান্য থেকে এতটা কিছু ঘটবে। ভুল করে নিবন্ত আগুনের টুকরো যেন পড়েছিল কোথাও তার থেকেই এমন কাণ্ডটা ঘটে গেল। বিহ্বল হল না অবনী, কিন্তু লজ্জায় সঙ্কোচে কেমন আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকল। অসহ অস্বস্তির মধ্যে সে অনুভব করতে পারল, সুরেশ্বর এবং হৈমন্তীর জীবনের একটি অতি নিভৃত ও গোপনতম অংশ যেন প্রকাশ হয়ে পড়েছে। তার মনে হল, গগন একবার কথা প্রসঙ্গে ভাসাভাসা ভাবে অসুখের কথা বলেছিল, কিন্তু কিছুই বোঝা যায়নি, বুঝতেও দেয়নি গগন। সুরেশ্বর এবং হৈমন্তীর সম্পর্কের কি তবে ওটাই আদি? জীবন পেয়েছিল বলেই কি হৈমন্তী সুরেশ্বরকে তার সমস্ত কিছু দিতে চেয়েছিল। নাকি সুরেশ্বর জীবন দিয়েছিল বলেই হৈমন্তীকে নিজের কাজে পেতে চেয়েছিল? এটা প্রায় ঋণ শোধবোধের মতন। হয়তো তা নয়। হয়তো সুরেশ্বর অধিকার চায়নি, সঙ্গী চেয়েছিল; হয়তো হৈমন্তী সঙ্গ চেয়েছিল, সংসার চেয়েছিল; সুরেশ্বরের বৈরাগ্য চায়নি। কে জানে! অবনী কেন যেন আজ অদ্ভুত এক বেদনা বোধ করল, তার এই বেদনায় অংশীদার ওরা দুজনেই সুরেশ্বর এবং হৈমন্তী। সে বুঝতে পারল না, হৈমন্তী কোন আবেগবশে তার জীবনের এই গোপনীয়তাটুকু প্রকাশ করল। নিছক উত্তেজনায় নয়, হৈমন্তী অত্যন্ত চাপা স্বভাবের, সংযত, শিষ্ট, ধীর। উত্তেজনার বেশি আরও কিছু কি আছে!