আপনার একটা মস্ত গুণ দেখছি… অবনী পরিহাস করে বলল।
কী?
যাবার সময় মনে কোনও রকম কালি মেখে যেতে চান না। সবাইকে ভাল লেগে যায়।
হৈমন্তী কোনও কথা বলল না, হাসিমুখে শুনল, শুনতে শুনতে হয়তো অন্যমনস্ক হল সামান্য।
আরও কয়েকটা হালকা কথাবার্তা হল। বাইরে বিকেলের আলো আছে এখনও, রোদ চোখে পড়ছিল না, বেলা ফুরিয়ে এসেছে, পাখিদের স্বর ক্রমশই প্রবল হয়ে উঠছিল, হৈমন্তী আরও বার কয়েক হাই তুলল। তার চোখ সামান্য জ্বালা করছে, মুখ গলা গরম লাগছিল। অবসাদ এবং গরমের ভাবটুকু কাটাবার জন্যে চোখে মুখে জল দেওয়া দরকার, আবহাওয়াটা কেমন শুকিয়ে এসেছে।
হৈমন্তী বলল, চোখ মুখ কেমন জ্বালা করছে, একটু ঠাণ্ডা জল দিয়ে আসি।
অবনী বলল, আসুন।
হৈমন্তী উঠে গেল। এ বাড়ির এখন সবই প্রায় তার চেনা।
.
হৈমন্তী ফিরে এলে বারান্দায় গিয়ে বসল ওরা। চোখ মুখ ধুয়ে এসে ঠাণ্ডায় হৈমন্তীর অবসাদ-ভাব অনেকটা কেটেছে। আগে একটা ক্লান্তির ভাব ছিল, এখন ভিজে মুখ সতেজ দেখাচ্ছে। কপাল এবং কানের পাশের চুলগুলি গুছোনো। মহিন্দর চা দিয়ে গেছে। চা ঢেলে শাড়ির আঁচলটা কোমরের কাছে টেনে নিয়ে চেয়ারের মধ্যে আরাম করে বসল হৈমন্তী। বিকেল ফুরিয়ে গেছে, আলো নেই, সামান্য অন্ধকার হয়ে এসেছে, বাতাস দিচ্ছিল, বাগানে তখনও পাখিদের গলা, স্টেশনের দিকে ট্রেনের শব্দ, বোধহয় আপ-প্যাসেঞ্জার গাড়িটা এসে গেল। চা খেতে খেতে বাকি অবসাদটুকুও যেন নষ্ট হয়ে আসছিল।
কলকাতায় যাবার কথা হচ্ছিল। অবনী আর-একবার জিনিসপত্র আনা, ট্রেনের কথা বুঝিয়ে বলে দিল। এখান থেকে একটা গাড়ি যাবে, বিছানা বাক্স এটা-সেটা বয়ে আনবে, এনে বাস-অফিসে রেখে দেবে, বিজলীবাবু মালপত্রের ঝামেলা সামলে সব ব্যবস্থা করে দেবেন। আর অবনী বিকেল নাগাদ যাবে গুরুডিয়ায়, গিয়ে হৈমন্তীকে নিয়ে আসবে। সন্ধের গাড়িটাতেই যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, একেবারে ভোরবেলায় হাওড়া। গাড়িটা অবশ্য ফাস্ট প্যাসেঞ্জার–কিন্তু সব দিক থেকেই সুবিধে, রিজারভেশান পাওয়া যাবে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কলকাতা। তা ছাড়া ওই গাড়িতে চেনা লোক যাচ্ছে বিজলীবাবুর, দেখাশোনা করবে, খোঁজখবর নেবে। সকালের গাড়িটায় কিছু কিছু অসুবিধে ছিল, নয়তো দিনে দিনে যাওয়া যেত! অবনী কাল একটা টেলিগ্রাম করে দেবে গগনকে।
অবনী আরও একটু চা নিল। হৈমন্তী চিনি মিলিয়ে কাপটা অবনীর হাতে তুলে দিয়ে নিজের জন্যেও সামান্য নিল আবার। আর হাই উঠছিল না, শরীরের অবসাদটুকুও মরে গেছে। এখন ভাল লাগছিল। ঠাণ্ডা ফুরফুরে বাতাস বইছে, বাগানের গাছপালা এবং ফুলের মিশ্রিত একটা গন্ধ আসছিল। ক্রমে আঁধার জমে এল।
অবনী বলল, আপনার তাড়া নেই তো?
না, মাথা নাড়ল হৈমন্তী, তাড়া আর কিসের। এখন আমার সময় কাটানোই মুশকিল।
কলকাতায় ফিরে গিয়ে কী করবেন?
দেখি।
চাকরিবাকরি নেবেন নাকি কোথাও?
কিছু ভাবিনি। চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকা আর-এক যন্ত্রণা। দেখি কী করি। চাকরি করতে ইচ্ছে করে না। পাচ্ছিই বা কোথায়। … বরং আমাদের চেনাশোনা দোকান-টোকান আছে সেখানে কোথাও বসব খানিক। শেষের কথাটা হৈমন্তী সামান্য হেসেই বলল।
নিজের বাড়িতেই একটা চেম্বার করে ফেলুন, অবনী হেসে বলল।
গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না জানেন! হৈমন্তী হেসে জবাব দিল, চোখও দেখতে হবে, পয়সাও পাব না; তার ওপর বদনাম।
বদনাম কেন?
ও হয়! মেয়েদের হাতে চোখ দেখালে লোকের বিশ্বাসই হবে না। হৈমন্তী মুখের সামনে থেকে পেয়ালাটা সরিয়ে নামিয়ে রাখল।
অবনী বলল, তা হলে তো দেখছি, এখানেই আপনার খাতির বেশি ছিল।
তা ছিল।
সিগারেট ধরাল অবনী। বারান্দা বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। বাতি জ্বালাবার জন্যে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। তবু উঠল পাশের দিকের বাতিটা জ্বালাল, বারান্দায় সামান্য আলো হল।
ফিরে এসে চেয়ারে বসতে বসতে অবনী লঘু স্বরে বলল, এখানে যে আপনার খুব সুনাম হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। সেদিন সুরেশ্বরবাবু আপনার খুব প্রশংসা করলেন।
হৈমন্তী তাকাল; কিছু বলল না।
অবনী কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বলল, সুরেশ্বরবাবুর বাড়ির লোকের সঙ্গে আপনাদের মেলামেশা ছিল না?
না– হৈমন্তী মাথা নাড়ল আস্তে করে, মা এক-আধবার ওর মা বাবাকে দেখেছে, মার দূর সম্পর্কের বোন হতেন ওর মা। আমি দেখিনি। একবার মাত্র ওর বাবাকে কলকাতায় আমাদের বাড়িতে দেখেছিলাম। ছেলেবেলায়। ভুলে গিয়েছি।
অবনী স্থির চোখে তাকিয়ে ছিল, শুনছিল। অবনীর জানতে কৌতূহল হচ্ছিল; সুরেশ্বরের মা আত্মহত্যা করেছিলেন কেন? স্বামীর জন্যে? স্বামীর উপপত্নীর প্রতি ঈর্ষা ও বিদ্বেষবশে? আপনি কি ভদ্রলোকের বাবার পরিচয় জানেন? সেই ছেলের কথা শুনেছেন?
অবনী বলল, আমার ধারণা ছিল ভদ্রলোকের জীবনটা বেশ সুখে-স্বচ্ছন্দে কেটেছে; বোধহয় তা নয়। অবনী এমনভাবে বলল যাতে মনে হবে সে স্পষ্ট করে না হলেও অস্পষ্ট করে কিছু জিজ্ঞেস করছে।
হৈমন্তী অবনীর মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে অন্য দিকে চোখ ফেরাল, তারপর বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকল। ঘাড়ের পাশ দিয়ে শাড়ির আঁচলটা অন্যমনস্কভাবে গোছালো একটু, চেয়ারের দিকে পিঠ আরও হেলিয়ে দিল। তার মুখ দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না।
অবনী যেন অপেক্ষা করছিল, শেষে বলল, এই অন্ধ আশ্রম করার পেছনে ভদ্রলোকের কিছু যেন আছে! শখ করে করেছেন বলে আমার আর মনে হয় না। আপনার কী মনে হয়?