হৈমন্তী হেসে বলল, কিছু না তো?
মিথ্যে বলে লাভ কি ভাই, সত্যি বলুন।
সত্যি কিছু না। আপনি কলকাতায় যাবেন বেড়াতে..
কলকাতায় যাব আমি! সরসীদি চোখ কুঁচকে হৈমন্তীকে দেখতে দেখতে যেন সব রহস্য বুঝে। নিলেন। বললেন, বয়ে গেছে। ছাই যাচ্ছি! ..।
বিজলীবাবু খানিকটা পথ এগিয়ে দিলেন। বিকেলের দিকটায় তাঁকে বাস-অফিসে থাকতে হয়। কিছুটা পথ এগিয়ে দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, সন্ধে নাগাদ পারলে তিনি অবনীর বাড়িতে যাবেন।
সাইকেলে উঠে বিজলীবাবু চলে গেলেন। এখন সবে বিকেল, বেলা বেড়েছে, রোদ আছে–মরে আসা রোদ, বাতাস এলেমেলো, খানিকটা উষ্ণতা এবং তাপ এ-সময়ে আজকাল অনুভব করা যায়। হৈমন্তীর শুকনো শুকনো এবং গরম লাগছিল; অল্প ক্লান্তি; সারাটা দুপুর গল্পে গল্পে কেটেছে, আলস্য জমেছে যেন। হাই উঠল। সরসীদির মুখটা যেন মনের ওপর ভাসতে ভাসতে চলেছে, বিজলীবাবুর মতনই স্বভাব একেবারে, রঙ্গ রসিকতায় ভরা। গোলগাল মুখ, চোখ দুটি হাসিখুশি মাখানো, নাকে পুঁতির দানার মতন নাকছাবি, ঠোঁট দুটি সব সময় পানের রসে লাল হয়ে আছে, মাথার কাপড়টুকু সরে না কখনও। সরসীদির বয়েস হয়েছে, ওর চেয়ে কিছু বড়ই, শরীরও ভারি হয়ে গেছে, তবু সরসীদির মধ্যে এখনও যেন কম বয়সের চঞ্চলতা মরেনি। আর হয়তো কোনও দিন দেখা হবে না–তবু হৈমন্তীর মনে হল, সরসীদির মুখটি মাঝে মাঝে তার মনে পড়বে। আর, হৈমন্তী ভাবল, সত্যিই যদি সরসীদি কলকাতায় যান–তবে সে সাধ্যমতো ভাল ডাক্তার দেখিয়ে দেবে। বড় বউ-এর মুখটিও মনে পড়ল। সত্যি, সব থেকেও যেন এই সংসারে কিসের অভাব একটা চাপা বেদনার মতন থেকে গেছে। হৈমন্তী খানিকটা উদাস এবং বিষণ্ণ হল।
কাঁঠাল এবং নিমগাছের ঝোপ পেরিয়ে টালি-ছাওয়া ছোট মতন বাড়িটার পাশ দিয়ে যাবার সময় হৈমন্তীর হঠাৎ মনে হল; এই রাস্তায় আজই তার শেষবারের মতন আসা, আর কখনও এখানে আসবে না; রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে চোখ তুলে চারপাশ একবার দেখল, বটের পাতা ঝরছে, মস্ত একটা আমগাছ, ঘুঘু ডাকছিল কোথাও, শালিখ এসে মিষ্টির দোকানের সামনে পাতা খুঁটছে, সামান্য দূরে দেহাতি মিঠাইঅলার দোকান, কয়েকটা বোলতা উড়ছে, কুকুর শুয়ে আছে একপাশে, গোরুর গাড়ি আসছে হেলেদুলে চাকায় শব্দ তুলে। দেখতে দেখতে এই মুহূর্তে হৈমন্তীর হঠাৎ কেমন দীর্ঘশ্বাস পড়ল; এইসব ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ।
সরু পথ ধরে এগিয়ে আবার বড় রাস্তায় পড়ল হৈমন্তী। তার পায়ের কাছে ছোট মতন একটা ঘূর্ণি উড়ছিল বাতাসের, নাকে মুখে ধুলোর ঝাঁপটা লাগল। তারপর রেল ফটক, দু দু-পাশে ফসল-তোলা শূন্য মাঠ, কাঁকর ছড়ানো উঁচু নিচু রাস্তা। আরও খানিকটা এগিয়ে আসতেই অবনীর বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়ল।
ফটক খুলে ঢোকার সময় বারান্দায় কাউকে দেখতে পেল না হৈমন্তী। বাগানে নতুন নুড়ি পাথর ছড়ানো হয়েছে, শব্দ উঠছিল। অবনী কি ঘুমিয়ে আছে? এই অবেলায় তার ঘুমোবার কথা নয়।
বারান্দায় উঠতেই অবনী ঘর থেকে বেরিয়ে এল। আসুন। আমি ভাবলুম আপনি বোধহয় ওখানেই থেকে গেলেন। ঠাট্টা করেই বলল অবনী।
হৈমন্তী হেসে জবাব দিল, তা সত্যি, উঠতে চাইলেও কি উঠতে দেন ওঁরা।
বসার ঘরে এসে হাতের ব্যাগটা রাখল হৈমন্তী, বসতে বসতে বলল, জল খাব। আজ খুব তেষ্টা পাচ্ছে। বলে কী যেন ভেবে বলল, একটু গরম গরম লাগছে, না?
অবনী মহিন্দরকে জল এনে দেবার কথা বলতে গেল। হৈমন্তী গা এলিয়ে বসল। ক্লান্তি এবং আলস্য লাগছিল। এখন যেন তার মতন লাগছে, দুদণ্ড চোখ বুজে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল। সারাটা দুপুর গল্পে গল্পে কেটেছে, খেয়ে উঠতেও বেলা হয়েছিল, তার ওপর এই গরম পড়ে-আসার মুখে শরীরে অবসাদ আসে এমনিতেই। বসে বসে হৈমন্তী হাই তুলল।
মহিন্দর জল দিয়ে গেল। হৈমন্তী জল খেয়ে বড় করে শ্বাস ফেলল স্বস্তির।
অবনী এল। বসতে বসতে হেসে বলল,ফেয়ারওয়েল কেমন হল, বলুন?
বেশ! …চমৎকার। হৈমন্তী হাসল।
কিছু পেলেন টেলেন? অবনী ঠাট্টা করে বলল, বলে সিগারেট ধরাল।
হৈমন্তী দুমুহূর্ত তাকিয়ে থাকল, চোখে স্নিগ্ধ হাসি; কী যেন ভাবল, বলল, হ্যাঁ পেয়েছি। বলে হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা টেনে নিল। তারপর রুমাল বের করে কপাল গলা মুছল।
অবনী বলল, আপনি যেভাবে ওটা টেনে নিলেন মনে হল কিছু বুঝি বের করে দেখাবেন।
হৈমন্তী হেসে ফেলল। পরে বলল, ওঁরা মানুষ বড় ভাল। বলে একটু থেমে সামান্য উদাস গলায় বলল, কী জানি চলে যাচ্ছি বলেই কি না, সব কেমন মনে হচ্ছে। বোধহয় কোনও জায়গা ছেড়ে যাবার সময় এই রকম হয়। হয় না?
অবনী বলল, মন খারাপ?
তা মন খারাপই হবে হয়তো।
অবনী কিছু বলল না, সিগারেটের এক মুখ ধোঁয়া আস্তে আস্তে বাতাসে ছড়াতে লাগল।
কলকাতায় গিয়ে এখন কিছুদিন এখানকার কথা খুব মনে পড়বে। …আমার আবার একটা খারাপ অভ্যেস আছে, কোথাও নতুন নতুন গেলে বার বার খালি ভুল হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠবভাবব এখানে আছি, কতবার যে মালিনীকে ডেকে ফেলব… হৈমন্তী বলতে বলতে হেসে ফেলল।
মালিনীকেই দেখছি আপনার খুব মনে ধরেছে। অবনীও হেসে জবাব দিল।
না না, তা কেন! কাছে কাছে থাকত তো৷ অভ্যেস…। হৈমন্তী থেমে বড় করে হাই তুলল। হাই ওঠার সামান্য শব্দ হল। ঈষৎ লজ্জার চোখে হাসল, সারা দুপুর গল্প করেছি। সরসীদির গল্পের শেষ নেই। কী চমৎকার মানুষ।