স্টেশনে এসে হৈমন্তী:দেখল, সে আসবে বলে ওরা আজ অপেক্ষা করছে। বিজলীবাবুর বাড়িতেই গেল সরাসরি। -সরসীদি, বিজলীবাবুর ছোট বউ, পথ চেয়ে বসেছিলেন, সদরে এসে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন: আসুন ভাই, সকাল থেকে চাতক হয়ে বসে আছি। সঙ্গে সঙ্গে বিজলীবাবুর কাছে। পেন্সিলে লেখা চিরকুট গেল সরসীদির।
বাকি সকাল এবং দুপুরটুকু বিজলীবাবুর বাড়িতেই কাটল। আদর-আন্তরিকতার অভাব ঘটল না কোথাও। সরসীদি যা করলেন সারাক্ষণ মনে হল যেন দূর দেশ থেকে কোনও আত্মীয় এসেছে বাড়িতে, এসেছে হঠাৎ আবার চলেও যাবে কয়েক ঘণ্টার পর এই সময়টুকুতে যতটা পারি আদর-যত্ন করি। ওমা, সে কী কথা ভাই, অমন সিল্কের শাড়িটা সারাদিন পরে নষ্ট করবেন কেন, আমি শাড়ি বের করে রেখেছি, পরুন, আহা, আপনার যেমন কথা, চলুন না–আমি মাথা ঘষে দিচ্ছি, একটুও ঠাণ্ডা লাগবে না, দেখতে দেখতে চুল শুকিয়ে যাবে…কী সুন্দর চুল আপনার…। হৈমন্তী কোনও কিছুতেই বড় আপত্তি করতে পারল না। পারল না কারণ, অল্প হলেও সরসীদির সঙ্গে যতটুকু আলাপ, যে কদিন দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে তাতে হৈমন্তী বুঝতে পেরেছিল মানুষটিকে না বলে দূরে সরিয়ে রাখা যায় না। গগন এসে সরসীদিকে আরও যেন নিকটজন করে দিয়ে গেছে। তা ছাড়া একটা সময় ছিল যখন হৈমন্তীর পরিচয় ছিল অন্ধ আশ্রমের ডাক্তার হিসেবে, পেশাদারি গাম্ভীর্যে এই পারিবারিক অন্তরঙ্গতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারত, সে-গাম্ভীর্যও আর নেই, পরিচয়ের দূরত্বও না। সরসীদির আদর-যত্ন, অন্তরঙ্গতা হৈমন্তীর অপছন্দও হল না; বরং অনেক দিন পরে সে এই পারিবারিক জীবনের স্বাদ ও স্পর্শ পেয়ে খুশি হল; মন স্নিগ্ধ লাগল।
বিজলীবাবুর বড় বউকে দূরে দূরে সরে সরে থাকতেই হৈমন্তী দেখেছে আগে; শুনেছে, ঠাকুর ঘরেই তাঁর সময় কাটে। যদিও সংসারের তিনিই মাথা–তাঁর কথাতেই সংসারটা চলে, তবু সংসারে পড়ে থাকতে তাঁকে বড় দেখেনি। পরিচয় থাকলেও কখনও উনি হৈমন্তীর সঙ্গে বসে সরসীদির মতন গল্পসল্প করেননি, অল্প দু-চারটে কথা বলে নিজের কাজে চলে গেছেন। দেখা গেল, আজ তিনি পুজোপাঠ এবং সংসারের সময় থেকে দুদণ্ড বাঁচিয়ে হৈমন্তীর সঙ্গে কথাবার্তা বললেন।
হৈমন্তীর বরাবরই মনে মনে একটা কৌতূহল ছিল: ছোট-র সঙ্গে বড়র ওপর ওপর যে সম্ভাব, ভেতরেও কি সেই সদ্ভাব আছে? এই মেয়েলি কৌতূহল অনেক সময় হৈমন্তীকে ব্যর্থ করেছে, কিন্তু বোঝা বা অনুমান করার মতন সুযোগ কখনও ঘটেনি৷ মেলামেশা থাকলেও যে এটা সহজে বোঝা যেত তা নয়; তবু কৌতূহল ছিল হৈমন্তীর। আজ তার মনে হল, বড় অর্থাৎ সরসীদির দিদি স্বামীর দেখাশোনা দায়-দায়িত্বের ভারটা সবই বোনের হাতে তুলে দিয়েছেন যেমন বাড়িতে বউ এলে ছেলের ভার মা বউয়ের হাতেই তুলে দেয়। কথাটা ভাবতে হাসি পায় অবশ্য, মজাও লাগে; কিন্তু ব্যাপারটা অনেকটা সেইরকম। সরসীদির হাতে বিজলীবাবুকে গচ্ছিত করে উনি আড়ালে সরে গেছেন। তাঁর আলাদা ঘর; একা থাকেন। সে-ঘরে যতটুকু যা আছে সব যেন কোনও পুরনো স্মৃতির মতন রেখে দেওয়া, এখন আর যা ব্যবহার্য নয়। বিজলীবাবুর সদ্য-যুবক বয়সের ছবি, বিয়ের পর তোলা দুজনের ফটো, এমনকী কার্পেটের রাধাকৃষ্ণ–এসবই পুরনো সংগ্রহ; নতুন কিছু নেই। একার বিছানা, একটিমাত্র বালিশ। ঠাকুর-দেবতার ছবিতে দেওয়ালের অনেকখানি ভরা–বোধহয় এইগুলোই তাঁর নতুন, আর কিছু নয়। সরসীদির ঘরের চেহারা আলাদা, সেখানে আসবাবপত্র সাজসজ্জা স্বতন্ত্র, পালঙ্কজোড়া বিছানা, কাজ করা সুজনি, কাচের আলমারিতে নানা ধরনের টুকিটাকি, পুতুল, সরসীদির বড় ছবি, বিজলীবাবুর-এক সময়কার সংগ্রহ হরিণের শিং ইত্যাদি। ঘরে গদিমোড়া ইজিচেয়ার, আলনায় পাটপাট জামা কাপড় ধুতি শাড়ি গেঞ্জি ব্লাউজ মেশামেশি। দেরাজের মাথার ওপর ফুলদানি, শাঁখ, নিকেলের ফ্রেমে বাঁধানো বিজলীবাবুর ফটো। বোঝাই যায়, এ-ঘরের সর্বত্রই দাম্পত্য জীবনের স্পর্শ, ও-ঘরে দাম্পত্যের কিছু নেই। হৈমন্তীর মনে হল, বড় যিনি তিনি বড় হয়েই থেকে গেছেন, ছোট হননি; দুঃখ হোক, বেদনা হোক, তবু তিনি অশান্তি করেননি। সরসীদির মনে মনে যে দিদির ওপর কৃতজ্ঞতা কতটা তা বোঝা না গেলেও বেশ বোঝা গেল, দিদির যেদিকে আঙুল সরসীদির সেদিকে পা।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে বেলা হল। অবনী এসেছিল; একেবারে ধুতি পাঞ্জাবি পরে। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে সে চলে গেল; বলে গেল বাড়িতেই থাকবে। দুপুরে শুয়ে শুয়ে সরসীদির সঙ্গে অনেক গল্প হল, বাড়ির গল্প, মা মামা গগনের গল্প। সরসীদির কত কৌতূহল! একবার মজা করে বললে, আপনি কি ভাই এইভাবেই থাকবেন? শুধু চোখ দেখবেন, চোখে কাউকে পড়বে না? হৈমন্তী হেসে ফেলেছিল, দেখি! ..দুপুর ফুরিয়ে আসতেই হৈমন্তী উঠল, বলল, এবার যাব।
আসার সময় বড় বউ নিজের ঘরে এনে বসালেন দুদণ্ড, দু-পাঁচটা কথা বললেন। শেষে হঠাৎ বললেন, সরসীকে একবার কলকাতায় পাঠাব। তুমি সবচেয়ে ভাল ডাক্তার দেখিয়ে দেবে, পারবে না? …ওর তো এখনও বয়েস আছে।
হৈমন্তী প্রথমটায় না হলেও পরে বড়র চোখের দিকে তাকিয়ে অর্থটা বুঝল। মাথা কাত করল, হ্যাঁ–পারব। মনটা কিন্তু বিষণ্ণ হয়ে এল।
সদর পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে সরসীদি একটু পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে শুধোলেন, কানে কানে কী বললে ভাই, দিদি?