আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না। কাজের মানুষকে অকাজে আটকে রাখব না। আমি আজ উঠি। উঠবেন!
এখনও তেমন রাত হয়নি। সন্ধে…
আপনাদের আশ্রমে একটু বেড়াই। …উনি তো রয়েছেন। হৈমন্তীকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল অবনী।
সুরেশ্বর হৈমন্তীর দিকে তাকাল। হেম, তোমার তো সন্ধে কাটে না। ওঁর সঙ্গে গল্পটল্প করো, আমি কাজটা শেষ করে ফেলি।
অবনী উঠে পড়ল।
সুরেশ্বরও উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি দু-একদিনের মধ্যেই আপনাদের দিকে যাব, দেখা করব। আপনি আর-একদিন আসুন। এখানেই দুটো খাবেন… আসবেন। আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করা যাবে। …তত্ত্বকথা ছাড়াও গল্প হয়। আমি নিজেও খুব একটা তত্ত্বের ভক্ত নয়। সুরেশ্বর সুন্দর করে হাসল।
অবনীও হাসল, বলল, আসব।
সুরেশ্বর হৈমন্তীর দিকে তাকাল, হৈমন্তী উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, হেম, অবনীবাবুকে আর-একবার চা-টা খাইয়ো। আমার এখানে অনেকক্ষণ আগে খেয়েছেন।
অবনী সিঁড়ি নামতে লাগল পেছনে সুরেশ্বর, শেষে হৈমন্তী।
সিঁড়ি নেমে অবনী বলল, আপনার এই বাড়ি বেশিদিন টিকবে না।
কেন?
ড্যাম্প…।
সবে বর্ষা গেল।
মাটির সঙ্গে কিছু মিশিয়ে নিতে পারতেন।
কয়েকটা বছর যাক তারপর দেখব।
সুরেশ্বর খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়ে বিদায় নিল।
জ্যোৎস্নাভরা মাঠ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অবনী বলল, ভদ্রলোক এখানে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছেন।
হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। নীরবে নতমুখে হাঁটতে লাগল।
অবনী আবার বলল, আমার কয়েকটা জিনিস জানতে কৌতূহল হয়। যদি কিছু মনে না করেন জিজ্ঞেস করি।
হৈমন্তী মুখ তুলে তাকাল। কী বিষয়ে কৌতূহল অবনীর? সুরেশ্বর সম্পর্কে কিছু জানতে চান, না তার বিষয়ে?
অবনী বলল, আমি ওঁর মুখে শুনেছি, এক সময়ে উনি কলকাতায় থাকতেন।
হৈমন্তী আস্তে করে মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, থাকতেন।
কী করতেন? অবনী শুধোল।
তেমন কিছু না। হৈমন্তী বলল।
পয়সাকড়ি ছিল বোধহয়।
কিছু ছিল।
আত্মীয়স্বজন নেই?
না। মা মারা যান আগে, পরে বাবা।
আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে ভদ্রলোকের মিল হল না। আমার মা পরে মারা যায়। কথাটা অবনী কেমন অকরুণ ভাবে বলল। হৈমন্তী কিছু বুঝতে পারল না।
অল্প কয়েক পা হেঁটে অবনী এবার বলল, উনি কি আপনাদের আত্মীয়?
চোখ তুলে পলকের জন্যে দেখল হৈমন্তী, চোখ নামাল। আমাদের পারিবারিক বন্ধু। আমার মার সঙ্গে ওঁর মার দূর সম্পর্কের একটা আত্মীয়তা ছিল।
অবনী ঘাড় ফিরিয়ে হৈমন্তীকে দেখছিল। আপনার মা…
আছেন। বাবা মারা গেছেন আমার ছেলেবেলায়। দাদা আছেন, চা বাগানে চাকরি করেন, ছোট ভাই আছে, চাকরি-বাকরি করে। এক মামা আছেন। হৈমন্তীর কেন যেন এই পারিবারিক কথা বলতে ভাল লাগছিল।
অবনী কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই হৈমন্তী বলল, এ-পাশে হাঁটুন–ওই যে–ওই বাড়িটা আমার।
বাড়ির কাছাকাছি এসে দ্বিধা বোধ করল হৈমন্তী। তার একটিমাত্র ঘর, বিছানা কাপড়-চোপড় বইপত্র থেকে শুরু করে যাবতীয় যা কিছু ওই ঘরে, ওই স্থানটুকুর মধ্যেই তার শোওয়া বসা বিশ্রাম-বিলাস। নিজের নিভৃতি এবং গোপনীয়তা বলতে যা কিছু সবই ওখানে। সামান্য পরিচিত এই পুরুষমানুষটিকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাতে হৈমন্তীর সঙ্কোচ এবং কুণ্ঠা জাগল। তা ছাড়া এই আশ্রমের স্বাভাবিক দীনতার স্পর্শ তার ঘরেও রয়েছে। অবনী নিজের চোখে তার নিভৃত জীবনযাপনটুকু দেখে যাবে হৈমন্তীর তাতে আপত্তি আছে। অথচ ভদ্রলোককে বসাবে কোথায়? বাইরে? সরু বারান্দাটুকুতে? অবনী যদি কিছু মনে করে? যদি ভাবে, এ কেমন ভদ্রতা? বাইরে বসিয়ে রাখা? সুরেশ্বরের ওপর রাগ হল। যুগলবাবুকে একটু ঘুরে আসতে বললে ক্ষতি ছিল না, কিংবা সুরেশ্বর যুগলবাবুকে নিয়ে ঘরে গিয়ে কাজ করতে পারত। তোমার তো ঘরের অভাব নেই, দুটো ঘর, আমার মাত্র একটাই।
মালিনী নিত্যকার মতন বারান্দায় বসে। চাঁদের আলোয় বারান্দা ভরে আছে। হৈমন্তীদের আসতে দেখে মালিনী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল।
কাছাকাছি এসে হৈমন্তী বলল, বারান্দায় বসি, চমৎকার জ্যোৎস্না..বাতাসও রয়েছে। বারান্দায় উঠে মালিনীকে বসার জন্যে কিছু আনতে বলল, তারপর নিজেও শেকল খুলে কিছু আনতে ঘরে ঢুকল।
হৈমন্তী বেতের একটা চেয়ার পেল নিজের ঘরে, মালিনী একটা মোড়া এনে দিল। অবনীকে বেতের চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে হৈমন্তী বলল, বসুন। …মালিনী, একটু চা করো ভাল করে।
অবনী বসতে বসতে হেসে বলল, এই মেয়েটি আপনার অ্যাসিসটেন্ট নাকি?
না; এখানে ও বছর খানেকের বেশি আছে। এমনি কিছু কাজকর্ম করে, আর রুগিদের দেখাশোনা করে খানিক।
নার্স?
না, নার্স নয়; তবে হাতে হাতে খানিকটা শিখেছে। হৈমন্তী বেতের মোড়ায় বসল। ওর ভাই আপনার অফিসে চাকরি করে।
শুনেছি। বিজলীবাবু সেদিন বলছিলেন।
হৈমন্তী ভাবল, মালিনীর আবেদনটা এখন জানাবে কি না। উচিত হবে কি? বরং মালিনী চা নিয়ে আসুক, মালিনীকে দিয়েই বলবে।
কয়েক মুহূর্তে কেউ আর কথা বলল না। অবনী একটা সিগারেট ধরাল।
হৈমন্তী নীরবে জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে বসে থাকল।
অবনী শেষে বলল, এখানে আপনার সময় কাটে কী করে?
হৈমন্তী সামান্য সময় কোনও জবাব দিল না, যেন তার অজস্র সময় যে কী বিশ্রী, নিরিবিলি ও শূন্যতার মধ্যে কাটে তা আবার মনে মনে অনুভব করে চাপা নিশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, সময় কাটানোই মুশকিল। …সকালে রুগি, বেলা বারোটা পর্যন্ত বড়জোর; তারপর আর করার কিছু নেই। একলা। ওই মালিনীই আমার কথা বলার সঙ্গী।