‘গেট আউট?… কার গায়ে তুই হাত তুলেছিস জানিস?’
‘আমি জানি। যে তোমাকে রেপ করে—’ গোরা কথাটা শেষ করার আগেই শাবলটা তার গলার পাশ দিয়ে বিদ্যুতগতিতে গিয়ে দেয়ালে আঘাত করল। রক্ত সরে গেল গোরার মুখ থেকে। পারুল শাবলটা আবার দু—হাতে তুলে ধরেছে। গলা লক্ষ করেই যে শাবলটা চালানো হয়েছিল সেটা গোরা বুঝে গেছে। আর বুঝে গেছে দ্বিতীয়বার এই মেয়েছেলেটা ফসকাবে না।
‘পারুল বিশ্বেস কী জিনিস আজ তোকে বুঝিয়ে ছাড়ব। আর একটা খুন হবে এ বাড়িতে।’
‘না, পারুল, না।’ সে উঠে দাঁড়িয়ে দু হাত মেলে পারুলের সামনে দাঁড়াল। ‘গোরা বেরিয়ে যা, নইলে ও খুন করে দেবে।’
পারুলের মুখের দিকে জ্বলন্ত চোখে একবার তাকিয়ে গোরা দ্রুত বেরিয়ে গেল, তার পিছনে হাফপ্যান্ট—পরা। ঘরে শুধু তারা দুজন, দরজার কাছে মন্তা। বুলি নিঃসাড়ে কখন যে বেরিয়ে গেছে, কেউ লক্ষ করেনি। শাবলটা সে পারুলের হাত থেকে তুলে নিল।
কাঁধ ঝুলে পড়েছে পারুলের, অবসন্নের মতো ধুঁকছে। একবার চোখ তুলে তাকাল তার মুখের দিকে। করুণ চাহনিতে পারুল কী বলতে চাইছে, সে যেন বুঝতে পারছে। তার মুখে ক্ষীণ একটা হাসি ফুটে উঠতে দেখে পারুলের চোখে পলকের জন্য আলো ফুটে উঠল।
‘ঘরে গিয়ে এখন শুয়ে থাক।’ পারুলের পিঠে হাত রেখে সে থাবড়াল। ষোলো বছর ধরে পারুল পরিশ্রম করেছে। ওর এখন বিশ্রাম চাই।
.
অন্ধকার ঘরে সে জানালায় দাঁড়িয়ে।
বাইরের চরাচর গাঢ় অন্ধকরে একাকার। বাতাস বইছে কি বইছে না, সে বুঝতে পারছে না। ঘুমের মধ্যেও পাখিরা ডেকে ওঠে, সে এখনও কোনো ডাক শুনতে পায়নি। গোরুটা আজ গভীর ঘুমে নিশ্চয়, যেমন হাঁসগুলোও। প্রকাণ্ড নৈঃশব্দ্য জানালায় ঝুঁকে রয়েছে। সে দু—হাতে শক্ত মুঠিতে জানালার গরাদ ধরে দাঁড়াল। বুকের মধ্যে শব্দহীন একটা প্রতিরোধ ঘনিয়ে উঠছে। মাছগুলো পুকুরের তলায় জলের চাপ সহ্য করে যেমন, এখন নিথর তেমনই সে এই নীরবতার চাপ গ্রহণ করছে। সে তার বাল্য, কৈশোর, যৌবনের স্মৃতির চাপ আত্মস্থ করবে। ধপে ধাপে সে শৈশবে ফিরে যেতে পারে, খুবই সুখের সফর হবে সেটা, কিন্তু ভবিষ্যতের দিকে হাঁটাটা? স্মৃতিতে ভরা একটা বিরাট বোঁচকা মাথায় নিয়ে হাঁটা!
সে তীক্ষ্ন নজরে দূরের দাওয়ার দিকে তাকাল। কেউ কি ওখানে বসে রয়েছে! থাকার কথা, আজ পারুলও জেগে থাকবে। বিছানা ছেড়ে উঠে এসে নিশ্চয়ই ওখানে বসবে। টর্চটা জ্বেলে একবার দেখবে কি?… মুখের উপর টর্চের আলো পড়েছিল বলেই পারুল চোখ বন্ধ করে ফেলে আর শ্রীগোপাল তখনই ওর হাতের কাটারিতে…
দাওয়ায় কেউ কি বসে? এত অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। সে একটা হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বন্ধ করে দিয়েছিল। স্পন্দন বন্ধ মানেই কি নৈঃশব্দ্য! বড়ো মূল্যবান শব্দ এই ধকধকানিটা, সে একটা মূল্যবান শব্দ বন্ধ করার জন্য দায়ী। একমাত্র পারুলই জানে, কেন সে দায়ী। আজ কি পারুল ঋণ শোধ করল? ওর চোখে বোধহয় সেই কথাই ছিল। ও কি ঋণমুক্ত হল?… হওয়া যায় কি, যাবজ্জীবন থেকে কখনো বেরিয়ে আসা যায় কি?
জানালার বাইরে অন্ধকার আর নৈঃশব্দ্য। দাওয়ায় এসে একজন বসবে। পারুলের চোখে পলকের জন্য তখন একটা আলো ফুটে উঠেছিল। সেই আলোটাই কি বিরাট হয়ে গিয়ে বলবে, ‘আপনিই সব কিছুর মালিক’!
সে জানালায় দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ন নজরে তাকিয়ে রইল।