পাতলা একটা ঘুমের আস্তরণের আড়লে জগতের সঙ্গে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে সে ব্যর্থ হচ্ছিল। নানান ধরনের শব্দ বাইরে থেকে জীর্ণ জানালা দরজা দেয়াল ভেদ করে তার চেতনায় ঢুকে পড়েছে আর সে সেগুলোকে আলাদা আলাদা করে কথায় রূপান্তরিত করে গেছে। একটা কথারও অর্থ সে ধরতে পারেনি। অস্বস্তিতে এপাশ ওপাশ করে একসময় তার মনে হল, সিঁড়িতে কার যেন উঠে আসার পায়ের শব্দ সে শুনল। কার শব্দ হতে পারে? এখানে কারুরই তো আসার সম্ভাবনা নেই! তবু মনে হল ঠিকই শুনেছে। বিছানায় সে উঠে বসল। খোলা দরজা দিয়ে আসা আলোয় ঘড়িটা টেবিল থেকে তুলে সময় দেখল… আড়াইটে!
বিছানা থেকে নেমে কলসি থেকে কাচের গ্লাসে জল গড়াল। চোখে জল দেবার জন্য গ্লাসটা নিয়ে ছাদের দিকে যেতে গিয়েই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে সে থমকে পড়ল। পাঁচিলবিহীন ছাদের উত্তরদিকের কিনারে মন্তা উপুড় হয়ে, তার বুক পর্যন্ত প্রায় কার্নিসের বাইরে। ও নীচের দিকে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে। সর্বনাশ, ও তো পড়ে যাবে! তার মনে হল, চেঁচিয়ে উঠলেই মন্তা চমকে যাবে তাইতে বিপদ ঘটে যেতে পারে।
সে পা টিপে ঘটে যেতে পারে।
সে পা টিপে মন্তার কাছে পৌঁছেই খপ করে ওর জামার কলারটা ধরে পিছন দিকে টান দিল। মন্তার রোগা দেহটা ছাদের ভিতরে হিঁচড়ে চলে এল। ভীত চোখে ও চিৎ হয়ে শুয়ে, মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে।
‘কী করছিস? এখুনি তো পড়ে যেতিস… কী দেখছিলি ওভাবে?’
মন্তা ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল, ‘কিছু না।’
‘কিছু না?’ সে ধমকে উঠল। ‘কিছু নয়তো, ওভাবে প্রাণ হাতে নিয়ে কেউ ঝুঁকে পড়ে?… বল কী দেখছিলি?’ সে কান ধরল মন্তার।
‘বল শিগগিরই… তোর মা কোথায়?’
‘ঘরে, শুয়ে আছে।
‘চল তোর মা—র কাছে।’
‘না।’ মন্তা ধাতস্থ হয়েছে। ওর চোখে বোকামিটা ফিরে এসেছে কিন্তু তা ছাড়াও আরও কী যেন ঝিলিক দিচ্ছে। কান থেকে সে হাত নামাল। দ্রুত ছাদের কিনারে গিয়ে নীচে তাকাল। ঝোপ, ঝাড়, ভাঙা ইট ছাড়া আর কিছু নেই। মুখ ফিরিয়ে মন্তার দিকে তাকাতেই দেখল, ওর সামনের দাঁতদুটো বেরিয়ে রয়েছে… হাসছে।
‘নীচের ঘরে বুলিদি।’
‘কী হয়েছে তাতে?’
‘ওর সঙ্গে দুটো ছেলেও।’
‘কী বললি?’ তার গলা দিয়ে অস্পষ্টভাবে কথাটা বেরোল। ‘দুটো ছেলে!’
‘হ্যাঁ জেঠু। দেয়ালের ভাঙা জায়গাটা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটুখানি… বুলদি শুয়ে আছে।’
‘কী বললি… কোন দুটো ছেলে?’ সে চাপা গলায় বলল, ‘কোন দুটো?’
‘বেঁটে মতন রোগাপানা হাফপ্যান্ট পরা আর সেই বড়ো ছেলেটা…’ মন্তা ভয়ে থেমে গেল একটা বিশাল হাঁ—করা মুখ দেখে।
‘ওহ গোরাআআ।’ আকাশের দিকে মুখ তুলে সে কাতরে উঠল।
জলের গ্লাস হাতে নিয়েই সে ঘূর্ণিঝড়ের মতো সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। খামার ঘরের ঝাঁপটা দরজার ফাঁকা জায়গায় দাঁড় করানো। সে একটানে ঝাঁপটা সরিয়ে নিয়ে ভিতরে তাকাল।
বুলি চিৎ হয়ে খড়ের উপর। তার দুই হাঁটু উঁচু হয়ে, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ দুটি শীর্ণ ঊরু দু—পাশে ছড়ানো। ঢেকে রয়েছে চওড়া একটা কালো গেঞ্জি পরা পিঠ, জিনসটা হাঁটু পর্যন্ত নামানো, ধবধবে দুটি বিশাল পাছা। একধারে দাঁড়িয়ে হাফ প্যান্ট পরা বেঁটে একটি ছেলে।
দুই কি তিন সেকেন্ড, সে ছুটে গিয়ে গোরার চুল মুঠোয় ধরে হ্যাঁচকা টান দিল, যেভাবে একটু আগে মন্তাকে টেনেছিল। গোরার মুখ উঠে গেল উপর দিকে। কয়েকটা মুহূর্তের জন্য দু—জোড়া চোখ পরস্পর জড়িয়ে রইল, তারপরই গোরা লাফিয়ে উঠে জিনসটা কোমরে টেনে তুলেই একটা ঘুষি চালাল। খট করে শব্দ হল চোয়ালে। সে দেয়ালে ছিটকে পড়ল। দরজার কাছ থেকে মন্তা ছুটে পালাল চিৎকার করতে করতে, ”মা, মা, জেঠুকে মারছে… মা জেঠুকে ছেলেটা মারছে… শিগগির এসো।’
রাগে অন্ধ হয়ে যাওয়া গোরা আবার ঘুঁষি চালাল। সে উঠতে যাচ্ছিল, মাথায় আঘাতটা লাগতেই আবার পড়ে গেল।
‘ব্লাডি রেপিস্ট!’
মেঝেয় মাথা চেপে বসে পড়া দেহটার পিঠে গোরা জুতো পরা পায়ের লাথি মারল। সে দেয়ালে ঢলে পড়ল। মনে মনে বলল, ‘এটাই পাওনা ছিল।’ দু—হাতে তার চুল ধরে গোরা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ‘মেয়েটাকে টাকা দিয়েছি, তোমার মতো ফ্রি পাবার চেষ্টা করিনি, আন্ডারস্ট্যান্ড?… ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?’ কথাটার সঙ্গেই সে থুথু দিল তার মুখে।
সে স্থির দৃষ্টিতে গোরার মুখের দিকে তাকিয়ে। তার মনে হচ্ছে এখন যেন তার নিজের চোখেই শ্রীগোপালের চোখ বসানো রয়েছে, ‘তুই আমাকে মারলি রোঘো!’ মুখের মধ্যে সে নোনতা স্বাদ পাচ্ছে।’
‘আমি রেপ করিনি রে।’ ফিসফিস করে সে বলল।
‘করিনি রে।’ গোরা ভেঙচিয়ে উঠল। ‘সারা বংশের নাম ডুবিয়েছ…. কেন, কেন,কেন আমরা সবাই সাফার করব, কেন?’ উন্মাদের মতো চাহনি গোরার। ‘মেরেই ফেলব আজ।’
‘রনো, থাক এবার …লেটস পুশ অফ।’ হাফপ্যান্ট—পরা এতক্ষণে কথা বলল।
‘যেতে হয় শালা তুই যা, আমি এই লোকটাকে শেষ করে যাব।’
‘আর একবার হাত তুলেছিস কি তোর লাশ এখানে পড়বে হারামজাদা!’
চমকে উঠে সারা ঘর ঘুরে তাকাল। শাড়ি গাছ—কোমর করা পারুল দরজায় দাঁড়িয়ে। উত্তেজনায় ওঠানামা করছে বিশাল বুক, ধকধক করছে চোখ, দু—হাতে তুলে রয়েছে শাবলটা। আপনা থেকেই গোরা এক পা পিছিয়ে গেল।
‘গেট আউট, গেট আউট।’ গোরা চিৎকার করে উঠল।