পারুল আজ একটু ব্যস্ত। একটা পুরনো বেডকভার আর লম্বা কাপড়ের পাড়ের ফালি বুলির হাতে দিয়ে বলল, ‘ছুট্টে হেমন্তকে দিয়ে আয় আর বেলার মা—র কাছ থেকে আমার নাম করে কয়লা ভাঙার হাতুড়িটা এনে কয়লাগুলো ভেঙে দে। তারপর বাটনা বাটা আছে… আজ তুই এখানে খাবি।’
সে দাঁড়িয়ে আছে চায়ের জন্য। চায়ের জল এখনও বসানো হয়নি। পারুল কৈফিয়তের সুরে বলল, ‘সকালে মুরগির জন্য গেছলুম নিশি মণ্ডলের বাড়ি … কেটে,ছাড়িয়ে আনতে দেরি হল; আমি আর হেমন্ত দুজনে মিলে উনুনটা বাগানে নিয়ে গেলুম,… গাছে কাক—শালিক রয়েছে, মাথার ওপর একটা কিছু ঢাকা না দিয়ে কি রান্না করা যায়? চাদরটা বার করে দিলুম … এখুনি চা হয়ে যাবে, একটু বসুন।’
পায়ে পায়ে সে উঠোন থেকে রাস্তার দিকে এগোল। আমবাগানের মাঝামাঝি সব থেকে বড়ো গাছটার নীচে রান্নার বাসনগুলো, তার সঙ্গে বড়ো একটা তোলা উনুন, কয়লার চাঙড়, কয়েকটা ঠোঙ্গা, কৌটো আর তেলের বোতল। চাদরটা হেমন্তর হাতে দিয়ে বুলি চলে যাচ্ছে বোধহয় হাতুড়ির খোঁজে। মন্তা জট পাকানো পাড়ের ফালি টেনে টেনে খুলছে। আজকের সকালটা খুব চমৎকার। ভাদ্রমাস পড়ে গেছে। ঝকঝকে রোদ, মেঘ নেই আকাশে, পুকুরের জলে ছায়া পড়েছে বাঁশঝাড়ের, খালপারের রাস্তা থেকে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং, আকাশে চিল, গা জুড়োনো বাতাস। আধবোজা হয়ে এল তার চোখ।
‘চা হয়ে গেছে।’
সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল পারুল এগিয়ে আসছে তার দিকে, হাতে একটা জারিকেন। ধ্বক করে উঠল তার বুক। মুহূর্তের জন্য একটা অশুভ ছায়া তার মনে ভেসে উঠল। পারুলের হাতে ওই জিনিসটা কেন?
‘স্যাঁতানো ঘুঁটে কি ওমনি ওমনি ধরবে কেরোসিন না দিলে!… আপনার চা ঢাকা দিয়ে রেখে এসেছি।’ পারুল তার পাশ দিয়ে আমবাগানের দিকে এগিয়ে গেল। ওকে পিছন থেকে দেখতে দেখতে আর একবার তার বুক কেঁপে উঠল। উঠোনে দাঁড়িয়েই চা খেয়ে সে উপরে উঠে এল। হঠাৎই কেমন যেন অস্থিরতা বোধ করছে। ব্লাড প্রেশার শুরু হল কিনা কে জানে! তাজা বোধ করছে অথচ একটা পুরোনো স্মৃতি তাকে অবসাদে ভরিয়ে দিল কয়েক মিনিটেই। সে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
একসময় সে মোটর এঞ্জিনের শব্দ পেল। কিছু উত্তেজিত পুরুষ কণ্ঠস্বর ক্ষীণভাবে তার কানে পৌঁছল। ওরা এসে গেছে। ওরা আজকের দিনটা উপভোগ করবে, ওদের মধ্যে গোরাও আছে। তার ইচ্ছে করল ছেলেকে পলকের জন্য হলেও একবার দেখতে। সে বিছানা ছেড়ে জানালায় এসে দাঁড়াল।
আমবাগানের খানিকটা জানালা থেকে দেখা যায়, বাকিটা বাঁশঝাড়ের আড়ালে। সেই আড়ালে—পড়া অংশেই রান্না হচ্ছে। সে অনেকক্ষণ চোখ পেতে রইল যদি একজনকেও দেখা যায়, কিন্তু কাউকেই দেখতে না পেয়ে নীচে নেমে এল। উঠোন পেরিয়ে যাবার সময় দেখল পারুল রান্না করছে। কোমরে জলভরা কলসি আর এক হাতে জলের বালতি নিয়ে বুলি চলেছে আমবাগানের দিকে। সে আর না এগিয়ে একটা খেজুর গাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।
টেপরেকর্ডারে রক সংগীতের সুর বাজছে। মন্তা উবু হয়ে রেকর্ডারটার পাশে বসে। ঘাসের উপর পাতা বেডকভারে একটি ছেলে চিৎ হয়ে শুয়ে, আর একজন পা ছড়িয়ে বসে। জিনস আর কালো গেঞ্জি পরা লম্বা চওড়া গৌরবর্ণের একটি ছেলে, চোখে সানগ্লাস, একাই শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে দুমড়ে মুচড়ে নেচে চলেছে। দেখামাত্রই সে গোরাকে চিনতে পারল। অতবড়ো শরীর আর কার হবে! এই নাচকে কী বলে … টুইস্ট? শ্যেক? নাকি অন্য কিছু।
গোরা একটু একটু করে সরে গিয়ে আচমকা বুলির পথ জুড়ে নাচতে লাগল। কলসি আর বালতির ভারে বেঁকে যাওয়া বুলি তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওকে পাক দিয়ে গোরা ঘুরছে। বেডকভার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে ছেলে দুটি এবার তালি বাজাতে শুরু করল।
দু—তিনবার পাক দিয়ে হঠাৎ নাচ থামিয়ে গোরা সিঁটিয়ে থাকা বুলির হাত থেকে বালতিটা টেনে নিল, কলসিটা নেবার জন্য অন্য হাত বাড়াতেই এবার বুলি পিছিয়ে গেল। বাবুদের ছেলে জল বইছে এটা দেখা বোধহয় ওর কাছে লজ্জার ব্যাপার। কলসির বদলে বুলির কাঁধ ধরে প্রায় ঠেলে নিয়েই গোরা রান্নার কাছে এগিয়ে গেল। জলের বালতিটা রেখে হেমন্তর সঙ্গে দুটো কথা বলে গোরা ফিরে গেল বেডকভারের দিকে। মন্তা হাসছে বুলির দিকে তাকিয়ে। ওরা তিনজনও হাসছে। ওরা আমোদ করতে এসেছে।
মোটরের হর্ন সে শুনতে পেল। আর একটা গাড়ি। গাড়িটা বাঁশঝড়ের আড়ালে থেমেছে বলে সে দেখতে পাচ্ছে না। ওরা তিনজন হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল। সে নবাগতদের দেখার আশায় উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইল। আরও চারজন, তাদের দুজন খুব খাটো হাফ প্যান্ট, আর ছাপমারা গেঞ্জি পরা, কার্ডবোর্ডের দুটো পেটি বয়ে এনে বেডকভারের উপর রাখল। এতদূর থেকেও সে চিনতে পারল পেটিদুটো বিয়ারের। ওরা আমোদ করতে এসেছে।
সে ফিরে এল। উঠোন দিয়ে যাওয়ার সময় পারুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শরীরটা ভালো নেই। আজ আর কিছু খাব না।’ নিজের ঘরে এসে প্রথমেই সে জানালাটা বন্ধ করে দিল। ওদের কারুরই এদিকে আসার দরকার পড়বে না। গোরা এসে তার বাবার সঙ্গে দেখা করবে এমন সম্ভাবনাকে আমল দেবার প্রশ্নই ওঠে না।
সত্যিই তার শরীর অবসন্নতায় ভরে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে তার ভিতরে কীরকম একটা ভয় নিঃসাড়ে ঢুকে এসেছে, সম্ভবত জারিকেন হাতে পারুলকে দেখেই কিংবা গোরার নাচের সঙ্গে। আজ সে একটা সুন্দর সম্পর্ক বোধ করেছিল প্রকৃতির সঙ্গে, এখন আর তা করছে না। যোগাযোগ করার পথগুলো এক—এক সময় মনে হয়েছে এত বেশি দীর্ঘ যে, সারাজীবন শুধু হেঁটেই যেতে হবে। হাঁটতে তার ভালো লাগে, যদি জানে শেষ পর্যন্ত একটা বিশ্রামের জায়গা পাওয়া যাবে। গোকুলানন্দে এসে পর্যন্ত সে হেঁটেই চলেছে। কিন্তু শ্রীগোপালের মতো কখনোই সে মাঝপথে বলবে না পাপ করেছি, করাপ্ট হয়েছি। সে কিছুই বলতে চায় না। গাছ, জল, আকাশ, বাতাস, মাছ, পোকামাকড়ের মতো কথা না বলে থাকতে পারলে সে কখনোই বলত না ‘উঠে পড়ো, পৌঁছে দিচ্ছি।’ … পৌঁছলাম। কিন্তু কোথায়?