তৈরি হবার জন্য সব কিছু থেকে মনকে গুটিয়ে এনে একটা জায়গায় জমা করতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফাৎনাটার দিকে তাকিয়ে থেকে তার মনে হয়েছে এটা একটা ভালো পদ্ধতি। সকালে ইস্টদেবতার নাম চোখ বুজে জপ করত মা কাঠের মালা বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। তখন মা—র মুখ দেখে তার মনে হত জগৎ—সংসার থেকে আলাদা হয়ে শুধু কোনো একটা জায়গায় যেন নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছে। … গুরুদেবের কাছে মন্ত্র নেওয়ার কথা জীবনে সে ভাবেনি, এখনও ভাবে না। সে এখন গভীরভাবে ফাৎনাটার দিকে তাকিয়ে থাকে, কখন ওটা ঠকঠক কেঁপে ওঠে, কখন সাদা কাঠিটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই ডুব দেয়।
আজ একটা চিংড়ির বাচ্চচা আর চারটে পুঁটি পেয়েছে। দেখে হয়তো মন্তা তার সামনেই হাসতে শুরু করবে। পারুল হাসে না। ও এমন একটা ভাব দেখায় যে, একটা কিছু নিয়ে তো লোকটাকে থাকতে হবে, এই নিয়েই থাকুক। সে যে ক—টা মাছ পায়, রাত্রে ঝাল বা ঝোলের বাটিতে ঠিক সেগুলোই তার কাছে ফিরে আসে। এই নিয়ে সে কোনো কথা বলে না। হয়তো পারুল বলে বসবে, ‘আপনার ধরা মাছ আমরা খাব কেন?’
পারুল মাটি খুঁড়ে মান কচুর গোড়া তুলছিল। তার পাশে উবু হয়ে বুলি পাতাগুলো ছিঁড়ে ডাঁটা জমাচ্ছে। সে ছিপ আর খালুইটা দাওয়ায় রেখে শুধু চেঁচিয়ে বলল, ‘ছিপটা রইল।’ এর মিনিট দশেক পরই হেমন্ত এল। কথা বলতে বলতে হেমন্ত থলিটা থেকে দুটো সাদা বাক্স বার করল। দেখেই সে বুঝল ওতে মিষ্টি রয়েছে। ব্যাপার কী? হেমন্ত একটা বাক্স পারুলের হাতে দিতেই ওর মুখে হাসি আর বিগলিত ভাব ফুটে উঠল। হেমন্ত অন্য বাক্সটা নিয়ে এবার খামার বাড়ির দিকে আসছে। সে অপেক্ষা শুরু করল একগ্লাস জল হাতে নিয়ে।
‘দাদাবাবু।’ দরজায় দাঁড়িয়ে হেমন্ত। সে তাকাল। ‘বউদিমণি পাঠিয়ে দিলেন … দাদামণি পাশ করেছে।’
হেমন্তর গালভরা হাসিটা চুপসে গেল দাড়িওয়ালা লোকটার চাহনি দেখে। ‘এতে কী আছে?’
‘সন্দেশ … অন্নদার।’
‘সেতো বাক্সর গায়ে লেখা থেকেই বুঝেছি। ছোটোবেলায় মিষ্টি খেতাম তারপর ছেড়ে দিয়েছি,তোমার বউদিমণি তো সেটা জানে।… ওটা নিয়ে যাও, বরং তুমিই খেয়ে নাও, বউদিমণি জানতে পারবে না।’
‘আপনার জন্য আনা … নিয়ে যাব!’ হেমন্ত মুশকিলে পড়ে গেছে। কলকাতায় ফিরে বলবে কী, সেটাই বোধহয় এখন ও ভাবছে।’
‘তোমার কাজ তুমি করেছ, কেউ যদি না নেয়—তুমি কী করতে পার।’
‘সন্দেশটা খুব ভালো ছিল, বউদিমণি আনন্দ করে পাঠিয়ে দিলেন, একটা অন্তত মুখে দেবেন তো!’
‘একটাও না। … এই নিয়ে আর কথা বোল না। তুমি কি সন্দেশ দিতেই কলকাতা থেকে এসেছ?’
হেমন্তর বলার ভঙ্গি চাকরবাকরের মতো নয়, আত্মীয়তার ছোঁয়া ওর কথায় লেগে আছে। ছেলের পাশের খবরে বাবা কিছুমাত্র উচ্ছ্বসিত না হওয়ায় ও যেন মর্মাহত। রূঢ় হওয়ার জন্য নিজেকে এবার তার দোষী মনে হচ্ছে। ‘ঘরে এসো, বাক্সটা টেবিলে রাখ।’
দমে যাওয়া হেমন্তর মুখ সতেজ হয়ে উঠল। ‘দাদামণি বন্ধুদের নিয়ে কাল পিকনিক করতে আসবে, তাই আমি এলুম সব ব্যবস্থা করে রাখতে।’ হেমন্ত বাক্সটা টেবিলে রাখল।
‘এখানে পিকনিক করবে? … ক—জন আসবে?’ স্কুলে পড়ার সময় সে—ও পিকনিক করে গেছে ক্লাসের ছেলেদের নিয়ে।
‘আমবাগানে রান্নাবান্না হবে। ওখানে তো আগেও হয়েছে। … আমিও অবশ্য দেখিনি। অরুণাদি বলল, বউদিমণি বন্ধুদের নিয়ে এসে পিকনিক করেছেন।’
বন্ধু! বিবির বন্ধু তো অপূর্ব! সঙ্গে আর কারা ছিল? গুলু, গোরা থাকবে, কিন্তু অপূর্বর বউ কি ছিল? অরুণা? … ‘আমিও অনেক কিছু দেখেছি, যাবার আগে সবাইকে বলে যাব।’ অরুণা এখানে কি কিছু দেখেছিল?
‘হাঁড়ি—কড়া বাসনপত্তর সবইতো পারুলদির ঘরে তোলা আছে। কয়লার উনুনটা আছে এই নীচের ঘরে। পারুলদি মুরগির জোগাড় করে দেবে, আমি রথতলা থেকে বিকালে কয়লা কিনে বাজার করে আনব। কলকাতা থেকে বাসমতি চাল, ব্যাসন, মুগের ডাল, গুঁড়ো দুধ, চা, কাগজের গেলাসও এনেছি, মাত্র ছ—সাতজন তো আসবে।’
হাত তুলে সে হেমন্তকে থামাল। ‘তাহলে তোমার তো এখন অনেক কাজ।’
‘কাজ তো সকালে। উনুন ধরিয়ে রান্নার তোড়জোড়… আমিই রাঁধব।’
বুলির ডাক নীচের থেকে শোনা গেল, ‘মামাবাবু, চা হয়ে গেছে।’
‘চলো, নীচে যাই। … রাতে থাকবে কোথায়?’
‘দাওয়াতেই রাতটা কাটিয়ে দেব।’
তারা দাওয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। স্টিলের গ্লাসে পারুল চামচ নাড়ছে। নাড়া শেষ হতেই সে হাত বাড়াল নেবার জন্য।
‘আপনার নয় … হেমন্ত চা নাও।’
‘দাদাবাবুকে আগ দাও।’ হেমন্ত দাঁড়িয়ে রইল।
এইবার সে লক্ষ করল চিনেমাটির কাপে পারুল লিকার ঢালছে। হঠাৎ তাকে খাতির! চাকরের সামনে মনিবকে গ্লাসে চা দেওয়া যায় না বলে? ডিস সমেত কাপটা নেবার সময় সে পারুলের মুখে চোখ রাখল। নির্বিকারমুখ পারুল শুধু বাঁ হাতে ঘোমটাটা বাড়িয়ে দিল।
সকালে নীচে সে দেখল খাবার ঘরের দরজার ঝাঁপটা সরানো। এখানে আসার পর একদিনও সে ঘরটার ভিতরে ঢোকেনি। ঝাঁপের ফাঁক দিয়ে প্রথম দিন যতটুকু দেখেছিল তাই—ই রয়েছে। তবে তখন সে দেখেনি, মেঝেয় ঝাঁটা আর এক কোণে ধানের বস্তার পাশে পড়ে থাকা তার মোটর বাইকের কঙ্কালটাকে। ভাঙা দেওয়াল, জানালার ফোকর,আঁটি বাঁধা খড় ছাড়া আর কিছু দেখার নেই। বাইকটা কলকাতার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিবি বিক্রি করে দিতে পারত! মাডগার্ড, হ্যান্ডল, আর এঞ্জিনটা চোরেরা কেন যে রেখে গেল! বাইকে শেষবারের মতো চেপেছিল পারুলকে পিছনে বসিয়ে, ভাবলে এখন অবাক লাগে।