চিঠিটা দু—বার পড়ে সে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। পরিষ্কার নীল। কিন্তু তার মনে মেঘের আনাগোনা। একটা কথা সে বুঝেছে, বিবি তাকে সন্ধি করে থাকতে বলছে। …পারুলই সর্বময়ী হয়ে থাকবে… তার ইচ্ছা—অনিচ্ছা পূরণে বিবির কোনো মাথাব্যথা নেই, বরং যে ইঙ্গিত শেষ বাক্যটিতে দিয়েছে সেটাই মারাত্মক। পারুল তাকে সম্মান না—ও দেখাতে পারে!… অপমান করবে?
খালি গ্লাস হাতে সে নীচে নেমে এল। গ্লাসটা দাওয়ার উপর রেখে সে ডাকল, ‘পারুল।’
ঘর থেকে পারুল বেরিয়ে এল বিস্ময় চোখে নিয়ে। সে বিবির চিঠিটা এগিয়ে ধরে বলল, ‘পড়ো’।
ভ্রূ কোঁচকাল পারুল, ‘আপনার চিঠি, আমি পড়ব কেন?’
‘এ চিঠি পড়া যায়, তোমারও পড়া দরকার।’
চিঠিটা হাতে নিয়ে পারুল ঘরে ঢুকে গেল, সে দাওয়ার সিঁড়িতে বসল। পারুল ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে। বিবির চিঠিতে শক্ত বানান নেই হাতের লেখাও পরিষ্কার, সুতরাং ছোট্ট চিঠিটা পড়ে ফেলতে ওর বেশি সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু লাগছে। সে মুখ ফিরিয়ে ঘরের ভিতর তাকাল। পারুল খাটের উপর বসে, হাতের চিঠির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে।
‘মুড়ি লাগবে নাকি গো?’ মাথায় ছোটো একটা বস্তা নিয়ে এক প্রৌঢ়া ঘরের সামনে এসে বলল। ‘না’। পারুল ঘর থেকে জানিয়ে দিল।
‘মামি, আমি চললুম।’ বুলি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেই উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে চলে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে এল পারুল।
‘আমি কিন্তু একটা কথাও বাড়িয়ে বলিনি, তবু বউদিমণি লিখল কেন, ‘বাড়িয়ে বলেছি’।
‘কেউ যদি কাউকে দোষী প্রমাণ করতে চায় তখন তার বিরুদ্ধে বাড়িয়েই বলে থাকে। বিবি সেটাই হয়তো ধরে নিয়েছে।’
‘আমি তো আপনাকে দোষী করার মতো কিছু বলিনি।’ পারুলের গলায় ক্ষীণ একটা গ্লানির ভাব তার কানে ধরা পড়ল।
সে পারুলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে বয়সের ছাপ পড়েছে, শরীরে এখনও যৌবনের শেষ রশ্মিটুকু থাকার কথা, কিন্তু রাত্রি নেমে আসছে। পঙ্গু একটা ছেলেকে নিয়ে গ্রামের নির্জন কিনারে একা ষোলো বছর ধরে বাস করা তরুণী বিধবার পক্ষে সহজ কথা নয়। উদবেগ ওকে কঠোর করে দিয়েছে, ঢেকে দিয়েছে রুক্ষ আবরণে। তবু ওর মধ্যে কোথাও একটা নরম জায়গা আছে, যেখানে ঘা দিলে ব্যথা পায়। ‘আমি তো আপনাকে দোষী করার মতো কিছু বলিনি, একটা কথাও বাড়িয়ে বলিনি।’ হয়তো বলেনি। কিন্তু কোর্টে আঙুল তুলে বলেছিল ‘এই লোকটাই।’ পারুল কি ভুলে গেছে?
‘তুমি কী বলেছ জানি না। কিন্তু আমি তো জানি, কী আমি বলেছি। … আমার তখন মাথার ঠিক ছিল না। ভালমনেই আমি মন্তার জন্য ওগুলো কিনেছিলাম, খুবই সামান্য জিনিস। কিন্তু তুমি যে ফিরিয়ে দেবে আমি তা ভাবতে পারিনি।’ সে উঠে দাঁড়াল। পারুল মুখ নীচু করে রয়েছে। ‘একটা লোকের সঙ্গে রথতলায় সেদিন আলাপ হয়েছিল। আজ তার বাড়িতে গেছিলাম, শক্তিপদ হালদার।’
‘শক্তি মাস্টার! কী জন্য?’
‘লোকটা স্কুলে পড়ায়, চাষবাসও করে, গ্রামে যে এমন বিচক্ষণ মানুষ পাব ভাবতে পারিনি। ওর কাছ থেকে কিছু জেনেটেনে নিয়ে নিজেই এই পাঁচ বিঘে জমিটায় সবজির চাষ করব ঠিক করেছি।’
‘আপনি করবেন!’ পারুলের মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটল।’ আপনি চাষের কিছু জানেন?’
‘তুমিও কি কিছু জানতে? জলে না নামলে কি কেউ সাঁতার শিখতে পারে?’
‘কী সবজি করবেন?’
‘টমেটো নয়তো কলা কিংবা কপি … ফুলকপি, মুলো, বেগুন।’
‘আমি ওই জমিতে ধান দিয়েছি, অন্য কিছু করতে দোব না।’ পারুলের হালকা হয়ে আসা কথার ভঙ্গি হঠাৎই কঠিন হয়ে গেল।’ মটর আর সরষে বুনে আমি লোকসান খেয়েছি। … সাঁতার শিখতে গিয়ে ডুবেও যায় মানুষ, তখন তো নিমিত্তের ভাগি হব আমিই! বউদিমণিকে কী বলব লোকসান হলে?’
পারুল সন্ধি করতে রাজি নয়। এখন আর কথা বলে লাভ হবে না। সে কয়েক পা এগিয়ে ফিরে দাঁড়াল। ‘শক্তি মাস্টার বলল, পঞ্চায়েত নির্বাচন আসছে, এবার মেয়েদের পঞ্চায়েত মেম্বার করা হবে, তুমি যদি ভোটে দাঁড়াও…।’
পারুল উঠে ঘরের ভিতর চলে গেল। ‘ভোট—ফোটে আমি দাঁড়াতে পারব না।’
দশ
আচমকাই বিকেলে হাজির হল হেমন্ত। একটা বাজারের বড়ো থলি ভরা জিনিস পারুলের দাওয়ায় নামিয়ে ডাকল, ‘পারুলদি।’
ওর গলার আওয়াজে প্রায় একই সঙ্গে গোয়ালের পাশে মানকচুর গোড়া শাবল দিয়ে খোঁড়ায় ব্যস্ত পারুল উঠে দাঁড়াল আর সে গিয়ে দাঁড়াল জানালায়। হেমন্তকে দেখে সে অবাক হল। হঠাৎ এখানে কেন এল? দুজনের কথা সে শুনতে পাচ্ছে না। মন্তার ছিপ আর একটা খালুই নিয়ে পুকুরে সারা দুপুর কাটিয়ে একটু আগেই সে ফিরেছে।
ইদানীং, সে দুপুরে মাছ ধরার ছুতোর সময় কাটায়। পুঁটি, খলসে, ট্যাংরার থেকে বড়ো মাছ এই ছিপে ওঠে না। চড়া রোদে আচ্ছাদনহীন জায়গায় বেশিক্ষণ বসা যায় না তাই তার বসার জায়গা ঘাটলার গায়ে নিম গাছটার নীচে। বুলি এখানে এঁটো বাসন মাজে, পাতের ভাত খাবার জন্য মাছগুলো ঘাটলায় আসে। স্বচ্ছ জলের নীচে ওদের ঘোরাঘুরি উপর থেকেও দেখা যায়। আর দেখা যায় আমবাগানটা। বড়ো বড়ো গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে দূরে শরৎ বসাকের বাড়িটা, আরও দূরে খালপারের রাস্তার একটুখানি। দু—চারটে মানুষ, ভ্যান রিকশা, সাইকেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখা যায়। শালিক, কাক আর ঘুঘু ছাড়া আর কোনো পাখির ডাক সে চেনে না। মাঝে মাঝে হঠাৎই বুলবুলি এসে যায়। পাখি চিনতে, পাখির ডাক চিনতে তার ইচ্ছে করে। তুলসীপাতার মতো গন্ধওয়ালা কমলা—সাদা ফুলের ঝোপ পুকুরের পাড়ে, বাড়িতে ইঁদারার ধারে, খামার ঘরটার পাশে। সে এই ফুলের নাম জানে না। কাউকে জিজ্ঞাসা করতেও লজ্জা করে। ধীরে ধীরে জেনে নেবে পাখিদের, ফুলেদের, মাছেদের, শাকপাতার নাম। ধান, মাটি, সার, বীজ, পোকামাকড় সম্পর্কে কিছুই সে জানে না। থিয়োরেম প্রব্লেমের মতো, সন—তারিখের কি পদ্যের অনেক নাম, অনেক ধরন, এদের মধ্যে অনেক রকমের সম্পর্ক, আলাদা চালচলন, এগুলো স্কুলে বইয়ের মতো মুখস্থ করা যায় না। এগুলো শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো শরীরের নিয়মের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হয়। এজন্য সময় লাগবে… ‘আপনি আগে তৈরি হয়ে নিন।’