‘একি উঠোনে ঘুরছেন যে, ঘরে চলুন।’ শক্তিমাস্টারের এক হাতে চিনেমাটির প্লেট অন্য হাতে জলের গ্লাস। প্লেটে চারটি নারকেল নাড়ু, দুটো ক্ষীরের সন্দেশ। ‘সব বাড়ির তৈরি।’
‘আমি কিন্তু…’ বলে সে সন্দেশ দুটো একসঙ্গে মুখে ঢোকাল, নাড়ু চারটে পকেটে পুরল। শক্তি মাস্টার হাসল। জল খেয়ে সে ‘এখন আসি, আবার আসব’ বলে সদর দরজার দিকে পা বাড়াল।
‘রঘুবাবু আপনি কিন্তু পারবেন।’
সে থমকে ফিরে দাঁড়াল। ‘কী করে বুঝলেন?’
‘যে লোক আমিই সেই খুনিটা’ পরিষ্কার গলায়, চোখে চোখ রেখে বলতে পারে, তার মনের জোর আছে, সাহসও আছে। সে পারবে।’
হায়রে সাহস! পারুল আর তার বউদিমণি, একজন রণমূর্তি ধরে, অন্যজন মার্জিতভাবে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে এই পৃথিবীতে তার জায়গা কোথায়। ছাব্বিশ নম্বর বাড়ির ছোট ঘরে প্রথম দিন ঢোকার সময় দরজায় হাত রেখে নিজেকে সে বলেছিল ‘এখনও বুঝতে পারছি না আমি কে!’
.
দাওয়ায় একা মন্তা। দেয়ালে ঠেশ দিয়ে পা ছড়িয়ে, হতে কাঁচি, একটা রঙিন ম্যাগাজিন থেকে ছবি কাটছে। পাশে গঁদের শিশি। ওর মা কোথায়? বেরোবার সময় সে পারুলকে দেখতে পায়নি। উনুনের দিকে সে তাকাল। একটা থালায় তার দুপুরের ভাত, দুটো বাটি, তার উপর উপুড় করা একটা থালা, নিবানো উনুনের উপর রাখা।
‘করছ কী?’
মন্তা ম্যাগাজিনটা তুলে দেখাল। সিনেমার। একটি মেয়ে যথাসম্ভব বুক খুলে চটুল চোখে এমনভাবে বসে যাতে উরুদুটো থেকে খাটো স্কার্ট উঠে যায়। সে অবাক হতে গিয়েও হল না। মন্তার সতেরো বছর বয়স, মেয়েদের শরীর দেখার ইচ্ছা ওকে তাড়া করতেই পারে।
‘পেলে কোথায়? মা দেখলে কী বলবে?’
প্রশ্ন দুটো এড়িয়ে গিয়ে মন্তা শুধু হাসল। সামনের দাঁত দুটো বেরিয়ে এল, হাসিটা ঠিক বোকার মতো নয়। পারুল তা হলে ঘরে নেই। সে পকেট থেকে নাড়ু চারটে বার করে বাড়িয়ে ধরতেই মন্তা ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে নিয়ে বলল ‘কে দিল?’
‘এখানে আমার এক বন্ধু আছে, সে দিল। …মা কোথায়?’
‘কলকাতা গেছে।’ মন্তা একটা নাড়ু মুখে দিয়ে চিবোতে শুরু করল।
শুনেই তার মনে হল, বিবির কাছে গেছে। নিশ্চয় নালিশ জানিয়ে বউদিমণির নির্দেশ চাইবে। নিশ্চয় বলবে, ‘আমি মালিক সব কিছুর, জমি জায়গা বাড়ির ‘সব কিছুর মালিক’ বলে চে�চিয়েছি। শুনে বিবির মুখে তৃপ্তির হাসি খেলে যাবে। হয়তো জিজ্ঞাসা করবে, ‘কি বলেছে? …তুমি আমার আশ্রিত? …দয়া করে থাকতে দেওয়া হয়েছে? বলতে দাও, যত পারে চেঁচাক।’
‘কলকাতায় কোথায় গেছে?’
‘জেঠিমার কাছে।’
‘তুমি জেঠিমাকে দেখেছ?’
‘খুব ছোটোবেলায়… এখানে একবার এসেছিল। খুব সুন্দর দেখতে।’
‘মা ফিরবে কখন?’
‘বলেছে বিকেলে ফিরবে, সকালে রান্না করে রেখে গেছে …লুডোটা রেখে দিয়েছেন এখনও?’
‘হ্যাঁ। তুমি কি ঘর পাহারা দিচ্ছ?’
‘মা বলে গেছে ঘর ফেলে রেখে কোথাও যেন না যাই। বুলিদি কাজ করতে আসবে, ও যা চোর একটা! গাছ থেকে কাঁটাল চুরি করেছিল! লোকের বাড়ি থেকে চাল চুরি করে, বাসন চুরি করে…খুব খারাপ হয়ে গেছে।’
‘তাই নাকি, খুব খারাপ?’ চোখ বড়ো করে সে হালকা সুরে বলল, ‘কতটা খারাপ?’
মন্তার মুখ বয়স্কদের মতো গম্ভীর হয়ে গেল। গলাটা নামিয়ে বলল, ‘খালপারের মেয়েগুলো যা করে বুলিদিও তাই করে… একদম খারাপ হয়ে গেছে। মা তো সেজন্য ওকে ওপরে যেতে দেয় না।’
তার গালে কেউ যেন ঠাস করে একটা চড় মারল। মুখটা জ্বালা করে উঠল। পারুল তার সম্পর্কে এতটা নীচু ধারণা করে! উনুনের উপর থেকে ভাতের থালাটা তুলে নিয়ে সে খামার বাড়ির দিকে এগোল।
‘জেঠু, গেঞ্জিটা এখনও আছে?’
সে জবাব দিল না। মন্তাকে তার বিশ্রী লাগছে।
বিকেলে সে পারুলের গলা শুনতে পেল। বুলিকে ধমকাচ্ছে।
‘কাজ ছেড়ে দে, তোকে আর করতে হবে না… অনেক লোক পাওয়া যাবে। …এখনও ঝাঁট দেওয়া, হাঁসগুলোকে তোলা কিছুই হল না।’
সে জানালায় উঁকি দিয়ে দেখল পারুল গরম জলের বাটি উনুন থেকে নামাচ্ছে, বুলি উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। জানালা থেকে সে সরে গেল।
‘বল চা হয়ে গেছে।’
রোজকার মতোই বুলি জানালার নীচে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে চেঁচাল ‘মামাবাবু চা হয়ে গেছে।’ বুলিকে দিয়ে উপরে চা পাঠানো যায় কিন্তু কেন পাঠায় না তার কারণটা সে মন্তার কাছে জেনেছে, বুলি ‘একদম খারাপ হয়ে গেছে।’
নেমে এসে চায়ের গ্লাসটা নেবার সময় পারুল তাকে বলল, ‘বউদিমণি একটা চিঠি দিয়েছে আপনাকে।’
সাদা খাম আঠা দিয়ে বন্ধ। খামে লেখা ‘শ্রীরাঘবেন্দ্রনারায়ণ দত্ত।’ চিঠিটা পারুলের সামনে খুলে পড়া ঠিক হবে না ভেবে সে দোতলায় উঠে এল। সে নিশ্চিত, পারুল তার বিরুদ্ধে কিছু বলেছে আর চিঠিটা সেই সম্পর্কেই।
তার অনুমানটা ঠিকই। লেটার হেড—এ সবুজ কালিতে বিবির নাম উপরে ছাপা, ‘শ্রীমতী জাহ্নবী দত্ত,’ নীচে বাড়ির ঠিকানা। মোটা ভারী ঝকমকে কাগজ।
বিবি চিঠিতে বরাবরই তাকে সম্বোধন করত ‘রঘু’, এই চিঠিতেও তাই। তাদের বাড়ির মেয়ে—বউদের মধ্যে বিবিই প্রথম ‘শ্রীচরণেষুর’ রীতিটা ভেঙেছে। বিবির হাতের লেখা মুক্তোর মতো, কোনো কাটাকুটি নেই।
‘পারুল যা বলল তার সবটা বিশ্বাস করছি না, কিছু নিশ্চয়ই বাড়িয়েছে। একটা কথা তোমার বোঝা দরকার, গোকুলানন্দে থাকতে হলে ওকে চটিয়ো না। পারুল শুধুই আশ্রিত নয়, তারও কিছু বেশি। সেটা তুমি জান। ওর সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা কোরো। ওখানকার জমিজমা ওর হাতেই থাকবে। ওখানকার সব কিছুর মালিক তুমি, এই ধরনের কথা, ওকে না বলাই ভালো। এতে নিজের সম্মান বাড়ে না। বিবি।’ শুধুই ‘বিবি’। তার আগে ‘ইতি’ নেই, তারিখ নেই। এটা চিঠি না অধস্তনকে নির্দেশ দেওয়া একটা সরকারি ফাইলের নোট!