‘বলুন, কী সাহায্য করতে পারি?’
সে ফাঁপরে পড়ল। পারুলের সঙ্গে তার ঝগড়ার পরই সে বুঝে গেছে, চাষ করব বললেই তার পক্ষে জমিতে কিছু করা সম্ভব নয়। বিবি আর পারুল, কেউই তাকে জমি ফিরিয়ে দেবে না। ফিরে পেতে গেলে যে জনবল আর অর্থবল থাকা দরকার তা তার নেই। কিন্তু এসব কথা তো শক্তিমাস্টারকে এখন বলা যায় না। তবু সে এসেছে সেদিনের ওই কথাটার টানে… ‘আপনি রিহ্যাবিলেটেড হতে চান, আপনি ক্রিমিন্যাল নন’, শোনার পরই তার বুক হালকা হয়ে গেছিল।
‘পারুল মেয়েছেলে, লিজ দিয়ে চাষ করানো ছাড়া ওর উপায় ছিল না। কিন্তু আমি যদি গোকুলানন্দে থেকে নিজেই লোক দিয়ে চাষ করি?’
‘পারবেন না। হঠাৎ চাষ করব বলে বাইরে থেকে এসে চাষ করা যায় না, একদম ডুবে যাবেন। অভিজ্ঞতা বলে একটা জিনিস আছে, আমার জন্ম কর্ম সবই এই গ্রামে। আমি মানুষদের জানি, জমি চিনি, প্রাকৃতিক ব্যাপার—স্যাপার বুঝি। বহু বছর গ্রামে বাস করে পারুল অভিজ্ঞ হয়েছে। আপনি আরও কিছুদিন বাস করুন, ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন।’ শক্তিমাস্টার ক্লাসের ছাত্রদের বুঝিয়ে বলার মতো থেমে থেমে ভারী গলায় বলল।
‘আমি যদি অল্প জমিতে, ধরুন আমার বাড়ির লাগোয়াই প্রায়, যে পাঁচ বিঘেটা রয়েছে, তাতে যদি সবজি বা ফলের চাষ করি?’
‘করুন না! জলে না নামলে সাঁতার শেখা যায় না, আপনি ছোটো জমিতে সবজি দিয়েই শুরু করুন। লোকসান হলে অল্পের উপর দিয়েই যাবে কিন্তু অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগবে।… আপনি কিছুটা জমিতে কলাগাছ লাগিয়ে দেখুন। কাঁটালি কলা কাঁদিতে পাবেন দেড়শোর মতন, ধরুন বারো ডজনই। যদি পাঁচ টাকা করে ডজন বেচেন, তাহলে একটা কাঁটালির কাঁদি থেকে পাবেন ষাট টাকা। আপনি যদি দুশো গাছ লাগান, তাহলে সব গাছ না বাঁচলেও, দশ হাজার টাকা আশা করতে পারেন। …. না না ওটা আপনি লাভ করছেন না। গাছ লাগানো আর বিক্রির মধ্যে একটা বড়ো খরচ আছে, অর্ধেক বাদ দিতে হবে। …যদি দুশো না পারেন একশো গাছ লাগান, হিসেব করে দেখুন কত পেতে পারেন।
সে একটা বিদঘুটে সমস্যায় পড়ল। মনে মনে একটা বিয়োগ, গুণ, ভাগের চেষ্টা করে, হাল ছেড়ে, সে শুধু হাসল।
‘আপনি টমেটো লাগান। … ফরাসি হাইব্রিড রেড স্টার বীজ এসেছে। খুব ভালো ফলন, চট করে রোগে ধরে না। … পেঁপেও লাগাতে পারেন। বিদেশি হাইব্রিড অনেক রকমের বীজ আসছে, লংকা, ঢ্যাঁড়স, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধা কপি। চাষের পদ্ধতি যতটুকু জানি আপনাকে বলে দোব, জমির ধান উঠলেই নভেম্বর কি ডিসেম্বর থেকে যাতে নামতে পারেন সেজন্য আপনি আগে তৈরি হয়ে নিন। আপনার জমির মাটি পরীক্ষা করাতে হবে, কোন মাটিতে কী সার লাগবে, তাতে কোন ফসল ভালো হবে। এটা সবার আগে জানা দরকার। এইসব না জেনেই তো ফসল বুনে মার খায়।’
শুনতে শুনতে তার মনে হল, চাষবাস অন্য একটা জগৎ নয়। এই জগতের মতোই এতে সাধনার দরকার হয়, অধ্যবসায় লাগে। একটা গাছ একটা প্রার। তাকে লালন করে বড়ো করতে হয়। এতে থ্রিল আছে। কেউ যেন গোরার মতো না হয়, মন্তার মতো না হয় সেজন্য সারাক্ষণ নজরে রাখতে হয়। ষোলো বছর তার যা করে ওঠা হয়নি, এবার সে তা পুরিয়ে নিতে পারে সবজি মানুষ করে। গোকুলানন্দকে বরাবরই অবহেলা করে, অন্যলোকের হাতে তুলে রেখে, আজ তাকে এক অপরিচিত লোকের সামনে বসে কিনা জিজ্ঞাসা করতে হচ্ছে ‘যদি সবজি চাষ করি?’
উঠোন থেকে একটি লোক ডাকল, ‘সেজদা আছেন?’ শক্তিমাস্টার ঝুঁকে দরজা দিয়ে দেখল। ‘নেপু নাকি, ভেতরে আয়।’ সে ঘড়ি দেখল। ‘আমি উঠি এবার।’ তার সঙ্গে শক্তিমাস্টারও উঠল। ‘অতদূর থেকে আজ প্রথম আমার এখানে এলেন, একটু মিষ্টিমুখ না করিয়ে কিন্তু ছাড়ব না… এক মিনিট।’ তাকে হতভম্ব করে শক্তিমাস্টার ভিতর—বাড়ির দিকে হনহন করে চলে গেল। নেপু নামের লোকটি ঘরে এসে বসল। বোধহয় প্রতিবেশী আত্মীয়।
অপরিচিত লোক, বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে, সে অস্বস্তি বোধ করে ঘরের বাইরে এল। আকাশ পরিষ্কার, মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। রোদের তাপে মাটির উপরের স্তর শুকোচ্ছে। মেটে গন্ধটা তার ভালোই লাগছে, পাঁচিলের ধারে দুটো টগর গাছের নীচে অজস্র সাদা ফুল ছড়িয়ে রয়েছে। তার মনে পড়ে গেল সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বাগানেও টগর গাছ ছিল। কারখানার জন্য ঘর তুলতে গিয়ে সেটা কেটে ফেলতে হয়। …সেই কারখানা আজ অন্য লোকের। মামলার খরচ তুলতে বিবি লিজ দিয়ে দিয়েছে। এখানে পারুলও তাই করেছে, তবে জমি যেকোনো সময় ফিরিয়ে নিতে পারবে। … পাঁচ বিঘের জমিটা যদি তাকে ছেড়ে দেয় পারুল!
শক্তি মাস্টার ভালো কথাই বলল, অভিজ্ঞতা চাই। ‘আরও কিছুদিন বাস করুন’, …সে করবে। ঝড়বৃষ্টি, পোকামাকড়ের সর্বনাশ থেকে দু—হাতে আগলে ধান, সবজি মানুষ করবে। বাচ্চচা থেকে বড়ো করে তুলবে। যে সন্তানদের দেখে বাবার মনে গভীর শান্তি ছড়িয়ে যায় তেমন সন্তান সে খেতে তৈরি করবে… পাগলের মতোই এবার থেকে সে ভাববে। পাগলরা মান—সম্মান অধিকার নিয়ে মাথা ঘামায় না। সে পারুলকে বোঝাবে, দরকার হলে বিবির কাছে যাবে…হাতজোড় করতে হয় যদি করবে। বাকি জীবনটা দোতলার ঘরে দিনরাত বন্দির মতো কাটিয়ে যেতে হবে ভাবলেই বুকের ভিতরটা হিম হয়ে যায়।… যাবজ্জীবন থেকে আর একটা যাবজ্জীবনে, পারুলকে চোখের সামনে রেখে বেঁচে থাকা!