ওর জন্যই হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে তাকে চারটে লোকের সামনে উলঙ্গ হতে হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিল মেয়ে। শরীরের যে জিনিসটা সে নিজে আর বাচ্চচা বয়সে মা ছাড়া আর কেউ স্পর্শ করেনি, বিবি তো নয়ই, ডাক্তার সেটাকে যখন আঙুলে তুলে দেখছিল তখন সে চোখ বন্ধ করে মৃত্যু কামনা করেছিল। তার শরীরে খোঁজা হয়েছিল বাধা দেওয়ার ধস্তাধস্তির চিহ্ন, তার পাজামা থেকে পাছার কাপড়ের টুকরো ডাক্তার কেটে নিয়েছিল ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য। সেই জায়গাটা তখন পাঞ্জাবি দিয়ে ঢেকে না নিলে তাকে পাগল বলে ভাবা যেত। … জীবনে সেই হেনস্থা, অপমান, লজ্জা কী করে ভুলবে! এই সবই পারুল দিয়েছে। সেদিন যদি ওকে বাঁচাবার জন্য সে শ্রীগোপালের মাথায়…।
কিছুক্ষণ পরেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।
.
শক্তি মাস্টার বলেছিল যেকোনো ছুটির দিন তার বাড়িতে যেতে, রাইহাটায় যে—কেউই তার বাড়ি দেখিয়ে দেবে। রাইহাটা প্রায় আড়াই মাইল। পতে ভ্যান রিকশায় উঠে পড়া যায়, যদি বসার জায়গা থাকে। সে রবিবার সকাল ন—টা নাগাদ বেরোল। হেঁটেই যাবে। বেরোবার সময় পারুলকে সে দেখতে পেল না।
খালপাড়ের রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই গ্রাম শেষ। তারপর একরের পর একর জুড়ে বিশাল ধানখেত। হাই টেনশান বিদ্যুতের মোটা মোটা তার লোহার থামে ভর করে খেতের উপর দিয়ে বহুদূর চলে গেছে। বৃষ্টির জলে কোমর ডুবিয়ে রয়েছে সবুজ ধান গাছ। আর মাস তিনেক পরই সোনালি রঙে ভরে যাবে মাঠ। খেত একজনের নয়। কারুর আট বিঘে, কারুর দু বিঘে করে জমি এর মধ্যে রয়েছে। বহুদিন আগে সে শ্রীগোপালকে বলেছিল, ‘এর মধ্যে থেকে নিজের জমিটা চিনে নেয় কি করে বল তো?’ শ্রীগোপাল বলেছিল, ‘একশোটা বাচ্চচার মধ্যে নিজের বাচ্চচাটাকে মা ঠিক চিনে নেয় যেভাবে।’ তার তিরিশ বিঘে ধানজমি এক লপ্তে নয়, তিন জায়গায় ছড়িয়ে আছে। কোথায় কত বিঘে রয়েছে সে জানে, কিন্তু দেখিয়ে দিতে বললে দেখাতে পারবে না,পারবে পারুল।
জনমজুর দিয়ে, ছড়ানো তিরিশ বিঘে জমিতে নিজে দাঁড়িয়ে চাষ করানো একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই লিজে চাষ করায় পারুল। এই কয়েক সপ্তাহে যে যতটুকু দেখেছে তাতে মনে হয়েছে পারুলের প্রতিপত্তি আছে চাষিদের কাছে। অল্পবয়সি তিনটে ভাই মিলে চাষ করে, ‘পারুল বউদির জমি’। এরা করে কুড়ি বিঘে, আর একটি লোক করে দশ বিঘে। বাড়ির কাছে পুকুরের ধারে পাঁচ বিঘেটায় সবজির বদলে ধান চাষ শুরু করেছে পারুল। বাড়ির লাগোয়া বলে এটা নিজেই লোক দিয়ে চাষ করাচ্ছে। ‘সাহস করে এগোলে সবই পারা যায়।’
পারুলের সাহস আছে আর আছে অদ্ভুত একটা মন। কোর্টে দাঁড়িয়ে পারুল তার দিকে আঙুল তুলে বলেছিল, ‘এই লোকটাই।’ সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছিল। সে ভেবেছিল, এতবড়ো মিথ্যা কথাটা বলতে ওর গলা কাঁপবে, চোখের দিকে তাকাতে পারবে না। কিছুই হল না। ওর শরীরে শ্রীগোপালের দেওয়া আঘাতগুলোই ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছিল বলে কোর্টে বিশ্বাস করে।…একদিন পরে পারুল রেপিংয়ের চার্জ এনেছিল। ওই একদিন তাকে সময় দিয়েছিল দারোগা বিজয় ঘোষ, পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়ার জন্য। পারুল কি ওই টাকার ভাগ পেত?… বিশ্বাস হয় না, টাকার জন্য পারুলের লোভ নেই।
রাইহাটা গ্রামটা বড়ো নয়। দুটি লোক রাস্তায় কথা বলছিল। তাদেরই একজন বলে দিল, ‘ওই তেঁতুল গাছটার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা, সেটা দিয়ে তিরিশ গজ গেলেই ডানদিকে শক্তি মাস্টারের বাড়ি।’ একমানুষ উঁচু পাঁচিলের একধারে দরজাটা খোলাই রয়েছে। ভিতরে ঢুকতেই মাটির একটা বড়ো উঠোন। একধারে উঁচু রকের সঙ্গে পরপর টিনের চালের তিনটে ঘর। দুটোয় তালা ঝুলছে। আর একধারে টালির চালের নীচে গাদাকরা খড়। তার পাশে গোয়াল। ভিতর বাড়িতে ঢোকার দরজাটাও খোলা। সে দরজায় উঁকি দিয়ে দুটো মরাই, একটা জবা গাছ আর তুলসী মঞ্চ ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না।
‘শক্তিবাবু আছেন নাকি?’ বেশ জোরেই সে ডাকল। বছর দশেকের একটি ছেলে ভিতর থেকে এল। ‘শক্তিবাবু আছেন?’
‘আছেন। আপনার নাম?’
‘বলো রাঘবেন্দ্র দত্ত।’
ছেলেটি চলে যাবার দু মিনিটের মধ্যেই পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে শক্তি মাস্টার বেরিয়ে এল। ‘চলুন, বারঘরে গিয়ে বসি।’
তালা খোলা ঘরটায় তক্তপোশ, তার উপর মাদুর, দুটো হাতলওয়ালা জীর্ণ কাঠের চেয়ার, দেয়ালে ইলেকট্রিক বালব আর গণেশের ছবি দেওয়া বাংলা ক্যালেন্ডার ছাড়া ঘরে আর কিছু নেই।
‘এই দশ মিনিট আগে কিছু লোকজন এসেছিল পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে। …এবার তো মেয়েরা পঞ্চায়েতে দাঁড়াবে।’ শক্তি মাস্টার একটা চেয়ারে বসল। তার সামনে তক্তপোশে সে। পঞ্চায়েত শব্দটা তার কানে প্রায় নতুন ঠেকল। ষোলো বছর আগে শুনেছে কিনা তার মনে পড়ছে না। গ্রামের চালচালন অনেক বদলে গেছে। ‘গোকুলানন্দ গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে পারুল বিশ্বাসকে ভোটে দাঁড়াতে বলুন না।… শক্ত মেয়েছেলে, ও পারবে।’
সে অবাক হল, অস্বস্তিও বোধ করল। নির্বাচন, ভোট মানেই তো রাজনীতি। পারুল রাজনীতির ধার ধারে বলো তো মনে হয় না, রাজনীতি করত শ্রীগোপাল।
‘পারুলকে বরং আপনারা কেউ বলুন, আমি বললে কানে তুলবে না… তার কারণ।’ সে থেমে গেল। শক্তি মাস্টার তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল কারণটা বুঝে নিয়ে।