‘বাইকে চেপেছি তো কী হয়েছে?’ পারুল মৃদু একটা রোখা স্বরে বলল।
‘কী হয়েছে!’ শ্রীগোপাল সটান সোজা হয়ে বসল। তার চোখের চাউনি বদলে গেল। নেশাগ্রস্তের চিহ্নমাত্র নেই, তার বদলে ধূর্তামি ঝিলিক দিল।
‘হয়েছে কী তাতে? আমার পিছনে বসলে কি কোমর জড়িয়ে ধরলেই পারুল খারাপ হয়ে গেল? … তোর মাথার এখন ঠিক নেই, শুবি তো শুয়ে পড়।’ সে একটা বড়া তুলে মুখে দিল তার নার্ভাস হওয়া গোপন করতে। কত স্বাভাবিক রয়েছে সেটা প্রকাশ করার জন্য সে অলস নিশ্চিন্তভরে চিবোতে লাগল।
‘কিছু হয়নি? … তোর মনের মধ্যে নোংরা ঢোকেনি? ও তোর মনে খারাপ চিন্তা এনে দেয়নি? … এই মেয়েছেলেটা জানত ওর বাপ কে, জেনেশুনেই আমাকে ট্র্যাপে ফেলেছিল। বিয়ের আগে এই ঘরেই ও আমার সঙ্গে রাত কাটিয়ে গেছে, তুই কি তা জানিস? ওর মা পাঠিয়ে দিয়েছিল, নইলে ওই খ্যাংরাকাঠির মতো মেয়েকে কে বিয়ে করত … আমাকে বলল, পেটে বাচ্চচা এসেছে, এখুনি বিয়ে করো… ‘
বড়ার থালাটা উড়ে এসে শ্রীগোপালের মুখে পড়ল। পারুল উঠে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে স্ফুলিঙ্গ, প্রচণ্ড রাগ দেহটাকে ফুলিয়ে দিয়েছে। থরথর কাঁপছে যেন কিছুর ভর হয়েছে। অস্ফুটে ‘তবে রে’ বলেই টেবিল থেকে চার ব্যাটারির টর্চটা তুলে শ্রীগোপালের দিকে ঝুঁকল। থালাটা মুখে জোরে আঘাত করেনি। শ্রীগোপাল আচমকা আক্রমণে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে ছিল কয়েকটা সেকেন্ড। টর্চটা তার মাথায় নেমে আসার আগেই সে হাতটা তোলে। হাতের উপর পড়ল টর্চের ভারী দিকটা। সে খপ করে পারুলের চুল মুঠিতে ধরে টান দিয়ে মাথাটা বিছানায় চেপে ধরল।
এত দ্রুত ব্যাপারটা ঘটে যায় যে সে কিছু করে উঠতে পারেনি। সম্বিৎ ফিরতেই চুল থেকে মুঠোটা ছাড়িয়ে নিতে সে শ্রীগোপালের হাত ধরে টানল। শক্ত করে ধরা মুঠো ছাড়াতে পারল না। পারুলের মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত, চোখ বন্ধ,ঠোঁট ফাঁক হয়ে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। শ্রীগোপালের চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে, ফুলে উঠেছে গলার শিরা, সারা মুখ ভয়ঙ্কর কোন ইচ্ছায় দুমড়ে যাচ্ছে, চোখের কোণে লাল ছোপ। সে দেখল শ্রীগোপালের চেহারা নেওয়া একটা হিংস্র পশুকে।
‘ওকে আমি খুন করব…আমাকে মারতে হাত তুলেছে, এত সাহস! … মেরে ফেলব আজ।’
সে ঘুষি মারল শ্রীগোপালোর বাহুতে একবার, দু—বার। মুঠো আলগা হতেই পারুল ঝাঁকুনি দিয়ে মাথা ছাড়িয়ে নিল। কিছু চুল শ্রীগোপালের আঙুলে লেগে। পারুল উঠে দাঁড়াল। ‘আজ আমিই তোকে খুন করব।’ পারুল ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে, দুড়দুড় করে নীচে নেমে গেল।
‘আমাকে মারলি রোঘো!’ শ্রীগোপাল অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে গিয়ে খাটের কোনায় ধাক্কা লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। হাঁটু চেপে ধরে ‘শাললা’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে শ্রীগোপাল খাটে একটা কিল মেরে বেরিয়ে গেল। সে তখন পুবের জানালায় এসে দাঁড়ায়। অন্ধকার উঠোন। দাওয়ার এক ধারে পলতে নামানো হারিকেন জ্বলছে। কয়েক মিটার পর্যন্ত দেখা যায়, তারপরই আবছা থেকে ঘন অন্ধকার।
ঘরের ভিতর থেকে পারুল ছুটে বেরিয়ে এল, হাতে একটা লম্বা কাটারি। পিঠের ওপর ছড়ানো চুল, শাড়ির আঁচল লুটোচ্ছে, হারিকেন পিছনে থাকায় মুখ অন্ধকার। দাওয়া থেকে নেমে পারুল ছুটে এল খামার বাড়ির দিকে। ও তাহলে সত্যি সত্যিই ‘খুন করব’ বলেছে, সে দেখল অন্ধকারের মধ্য থেকে শ্রীগোপাল এগিয়ে গেল, হাতে একটা লম্বা লাঠির মতন কিছু। সে জলদি টর্চটা বিছানা থেকে তুলে জানালা দিয়ে উঠোনে আলো ফেলল। মুখের উপর তীব্র রশ্মি পড়তেই পারুল চোখ বুজল আর তখনই শ্রীগোপলের হাতে ধরা বাঁশের খোঁটাটা পড়ল কাটারির উপর। টর্চ নিবিয়ে সে ছুটেছিল সিঁড়ির দিকে। যখন উঠোনে পৌঁছল তখন পারুল মাটিতে চিৎ হয়ে শ্রীগোপাল। তার ডান হাত হাঁটুতে চেপে বুকের ওপর ঘোড়সওয়ারের মতো বসে, এক হাতে পারুলের বাঁ হাতটা মুচড়ে ধরে রয়েছে, অন্য হাতে গলা টিপে। ঘড়ঘড়ে দমবন্ধ আওয়াজ পারুলের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে। পা দুটো মাটিতে দাপাচ্ছে। কুঁজো হয়ে শ্রীগোপাল মুখটা পারুলের মুখের কাছে রেখে ‘ইঁ ইঁ ইঁ’ শব্দ করে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। তখন তার মনে হয়েছিল, পারুল মরে যাচ্ছে।
কাটারিটা তার পায়ে ঠেকল, সে তুলে নিল।
.
‘না, না, না!’
সে উঠে বসল বিছানায়। মাথা নীচু করে বিছানায় কিছুক্ষণ বসে থেকে চোখ খুলল। জানালায় তাকিয়ে ময়লা কাপড়ের পরদার মতো আকাশ দেখতে পেল। আর একটু পরেই ভোর হবে। যে ভয় করে এসেছে সেটাই ঘটল, সে এই স্বপ্নটা দেখল।
যদি না বিকেলে পারুল আর সে মুখোমুখি হত, প্রচণ্ড রাগে চোখের সামনের সব কিছু তার দৃষ্টি থেকে যদি মুছে যেত তাহলে সে বোধহয় স্বপ্ন দেখত না। সব কিছু মোছেনি… ষোলো বছর আগে দোতলার ঘরে শ্রীগোপালের সামনে ক্রোধে ফুলে ওঠা পারুলকে সে দাওয়ায় দেখতে পেয়েছিল। …’অধিকার দেখাচ্ছেন, অধিকার!’ কদাচিৎ দেখা যায় স্ত্রীলোকের এই রূপ, সৌন্দর্য! পলকের জন্য তার মনে ভেসে উঠেছিল মহিষাসুরের দিকে তাকানো দুর্গার চোখ।
দু—হাতে সে মাথা চেপে ধরল। সেই যন্ত্রণাটা আবার শুরু হয়েছে। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে দড়ির আলনার কাছে পৌঁছে পাঞ্জাবিটা নিল। সেটা পাকিয়ে শক্ত করে মাথায় বেঁধে সে শুয়ে পড়ল। পারুল তাকে কি ঘেন্না করে, কেন? সেদিন শ্রীগোপাল ওকে মেরেই ফেলত, সে বাঁচিয়েছে। অথচ কোর্টে পারুল একদম উলটো কথা বলল। যা শেখানো হয়েছিল তাই বলেছে। কেন রাজি হল বলতে? ও কি আমাকে সাজা দিতে চেয়েছিল! যাবজ্জীবন সাজা তো জেলে ঢোকার আগেই সে পেয়েছে।