পারুল নেমে গেছে নীচে, তার সঙ্গে বুলি। ঘর ছিল অন্ধকার। তারা সারা শরীরে লেগে ছিল পারুলের স্পর্শ। একতলা থেকে ‘পারুল, পারুল’ চিৎকার করতে করতে শ্রীগোপাল যখন উঠে আসছিল, তখন একটা ভয় তার কলজেটা চেপে ধরে। শ্রীগোপাল কি কোনো সন্দেহ করবে?সে কাঁটা হয়ে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল।
‘হারিকেনটা জ্বালিসনি কেন?’
‘এই জ্বালছি।’
সে টর্চ জ্বালল, তারপর হরিকেন। শ্রীগোপালের চোখ পড়ল বোতলে। ‘খুলেছিস?’ ‘সবে একটু খেয়েছি।’ শ্রীগোপাল ছিনিয়ে নেবার মতো করে বোতলটা তুলে নিয়ে খাটে বসল। গ্লাসটা সে এগিয়ে দেয়। ‘রাখ, লাগবে না।’ সারাদিন খাসনি, একটু কিছু পেটে দে।’ কথাটা বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিল, ঠিকমত বললে পালিয়ে গেছিল। শ্রীগোপালকে তার করুণার পাত্র মনে হচ্ছিল। বোকাটা জানে না, একটু আগেই এই ঘরে বউ ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সে চাপা গলায় ডেকেছিল ‘পারুল, পারুল।’ দাওয়ায় ছেলে কোলে বসেছিল বুড়ি, তার পাশে বুলি। ঘর থেকে বেরিয়ে এল পারুল। সিল্কের শাড়িটা বদলে আটপৌরে শাড়ি পরে নিয়েছে। কপালে টিপটা নেই। হাতের আঙুল খালি। চোখে চাপা উৎকণ্ঠা। পারুলও ভয় পেয়ে গেছে।
‘কিছু খেতে দাও ওকে, আছে কিছু?’ আপনা থেকেই তার স্বর ফিসফিসে হয়ে যায়।
‘ডালবাটা আছে, বড়া করে দোব লংকা দিয়ে?’ পারুলও গলা নামিয়ে বলেছিল।
তারা পরস্পরের চোখের দিকে চোখ রেখে নিথর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। দুজনেই কী কথা তখন বলতে চেয়েছিল? তখনই কি বিদ্বেষ আর ঘৃণা জন্ম নিচ্ছিল? দুজনে প্রায় একই সঙ্গে দোতলায় পুবের জানালার দিকে হঠাৎই তাকায়। তার মনে হয়েছিল, একটা মানুষের ছায়া যেন জানালায় দাঁড়িয়ে। পারুলেরও কি তাই মনে হয়েছিল?
‘ধরুন’।
চায়ের গরম গ্লাস রেকাবির উপর রেখে পারুল তার সামনে দাঁড়িয়ে। মাথায় ঘোমটা, মুখ স্বাভাবিক। একটু আগে যে বিশ্রী ভঙ্গিতে কর্কশস্বরে চিৎকার করেছিল, তার কোনো চিহ্ন ওর স্থূল দেহে লেগে নেই।
তার মাথার মধ্যে যে আগুন জ্বলে উঠেছিল সেটা নিবে এসেছে। শুধু ধিকিধিকি করছে একটা কথা, ‘বউদিমণির দয়ায় তো আপনি এখানে থাকতে এসেছেন।’ কথাটা সত্যি। রেকাবিটা হাতে নিয়ে সে যাওয়ার জন্য ঘুরতেই চোখ চলে গেল দোতলার জানালায়। মন্তার ভীত মুখ ভাঙা গরাদের ফাঁকে। সে পিছনে তাকিয়ে দেখল, পারুলের চোখও জানালার দিকে।
‘দোতলায় উঠে এসে সে মন্তাকে বলল, ‘ওগুলো রেখে যাও।’
‘আপনি রাগ করেচেন?’
‘না।’
নয়
সেই রাতে একটা ভয়ঙ্কর কিন্তু সত্যি স্বপ্ন সে ঘুমের মধ্যে দেখল।
দোতলার ঘরে তারা তিনজন। একটা থালায় কয়েকটা ডালের বড়া। শ্রীগোপাল চোখের পাতা খুলে রাখার চেষ্টা করছে। সে আর পারুল একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে শ্রীগোপালের মুখের দিকে।
‘বড়ো অন্ধকার লাগছে রে রোঘো, হারিকেনটা জ্বালা।’
সে হাত বাডিয়ে পলতেটা উসকে দিল।
‘রোঘো, আমি তোকে অনেক ঠকিয়েছি। …তুই কি জানিস আমবাগান জাম দিয়ে,পুকুর জমা দিয়ে যে টাকা পেয়েছি তার সবটা তোকে দিইনি। বাঁশ বিক্রির সব টাকা দিইনি… তুই কি তা জানিস?’
‘জানি।’ সে পারুলের দিকে তাকাল। পাথরের মতো ওর চোখ। চোখের পিছনে কী ঘটে চলেছে তা বোঝা যাচ্ছে না। হারিকেনের শিখা লালচে হয়ে এসেছে, বোধহয় তেল কমে গেছে। শ্রীগোপাল ঝুঁকে পড়ছে ক্রমশ।
‘জানিস? তা হলে চোর বলে এতদিন আমাকে ধরিসনি কেন? … আমি জানি কেন ধরিসনি। তুই জানিস আমি করাপ্ট হয়েছি তোর জন্য, তোর জমি রক্ষার জন্য ওদের ভুল বুঝিয়েছি, বিট্রে করেছি। আমার সঙ্গে তুইও নষ্ট হয়ে গেলি। তোর নষ্ট বিবেকের সুযোগটা আমি নিয়েছি। … আমি আজ তোর এখানে শোব, শুতে দিবি?’
‘হ্যাঁ।’
‘পারুল সম্পর্কে আমার কে হয় জানিস? ওর সঙ্গে শুয়ে আমি পাপ করেছি। সেই পাপের ফল আজ আমি পেয়েছি। আমার দশ হাজার টাকার মাল সিজ করে নিল।’
পারুলের ভ্রূ কুঁচকে রয়েছে। শ্রীগোপাল কী বলবে সেটা যেন ও জানে। মুখ নীচু করে দুটো আঙুলে চেখের পাতা টিপে ধরল।
‘বাবার ফোটো আমার কাছে আছে। পারুল আর আমার ফোটোও আছে। পাশাপাশি তিনটে ছবি রেখে আমি দেখেছি… এক মুখ…তুই হাসছিস, পাগল ভাবছিস? … পারুলের মা জানত পারুলের বাপ কে, কিন্তু কিছু বলেনি, আমার সঙ্গে পারুলের বিয়েতে আপত্তি করল না। … বিয়ের খবর শুনে দুলালদা আমাকে বলেছিল, ‘পারুলের বাপ তোর বাবা,বোনকে বিয়ে করলি?’ রেঘো, তখন ছেলেটা ওর পেটে এসে গেছে, আমার আর কিছু করার ছিল না।’
‘কী করে যে মাথায় এই সব ঢুকল।’ ফিসফিস করল পারুল।
‘কে আবার ঢোকাবে…ভগবান ঢুকিয়ে দিয়েছে। … জীবনের বড়ো ভুল কী করেছি জানিস?’ শ্রীগোপাল সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করতে করতে তাকাল তার দিকে। ‘ছেলের জম্মো দিয়ে। … ওর ঠাকুদ্দা আর দাদামশাই একই লোক, একথা একদিন তো জানবে, তখন কী বলবে আমায়? … রেঘো আমার ভয় করে।’
‘কি আজেবাজে বকছিস। শুয়ে পড় তুই।’ সে ছোট্ট ধমক দিল। ‘পারুল তুমি ঘরে চলে যাও।’
‘না না, থাকুক আমার সামনে। … পারুল আজ তোর মোটরবাইকে চেপেছে, তোর কোমর জড়িয়ে পিঠে বুক ঠেকিয়েছে, পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছে … সবই কানে এসেছে। কিরে রোঘো, কেমন লাগছিল বল তো?’
ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল তার মুখ। শ্রীগোপাল মুখ তুলে ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। মুখে হালকা হাসি। পারুলের চোখে কোনো ভাব নেই। কথাগুলোর প্রতিবাদ করা যায় না। সে বাইকে ওঠার জন্য কয়েকবার পারুলকে বলার পর উঠেছিল। না উঠলেই পারত। শখ ছিল মিটিয়ে নিল, এটা কি একটা কারণ? শখেরও বেশি আরও কিছু ছিল।