‘এখন ক—টা ডিম দিচ্ছে?’ প্রশ্ন করল বুলিকে।
ঘরের ভিতর থেকে মন্তা চেঁচিয়ে বলল, ‘আজ দিয়েছে তিনটে। কাল দুটো দিয়েছিল।’ মন্তা ঘর থেকে বেরিয়ে এল, কোমরে মুঠো করে প্যান্টটা ধরা। গেঞ্জিটা বুক—কাঁধ ঠিকই হয়েছে, শুধু ঝুলটা একটু বেশি।
‘বাহ, চমৎকার দেখাচ্ছে… কাল পরে স্কুলে যেয়ো। প্যান্টের কোমরটা বড়ো হয়েছে, না?’
‘দড়ি দিয়ে বেঁধে নিলে ঠিক হয়ে যাবে।’ পঙ্গু পায়ের দিকে মন্তা হেলে রয়েছে। মুখ নীচু করে কাঁধ—বুক বারবার দেখছে।
‘টফিগুলো একবারেই যেন শেষ কোর না। ঠোঙাটা আনো, বুলিকে একটা দিই।’
মন্তা ঠোঙা আনল। সে একটা টফি হাতে নিতেই মন্তা বলল, ‘জেঠু, এগুলোকে টফি বলে?’
‘হ্যাঁ… বুলি এদিকে এসো।’ দুটো টফি তুলে নিয়ে ঠোঙাটা সে মন্তাকে ফিরিয়ে দিল।
‘আপনি খাবেন না?’
‘না, বড়োরা খায় না…বুলি এ দুটো তোমার ছেলেদের।’
সে উঠে দাঁড়াল। বুলিকে দেখে তার মনে হল কিছু যেন বলতে চায়। ‘আর একটা টফি চাই?’
বুলি লজ্জা পেল। ‘না, …একটা কথা বলব?’
‘বলো।’
‘কলকাতায় তো আপনার অনেক চেনাজানা আছে, কারও বাড়িতে একটা কাজ ঠিক করে দিতে পারেন?
তার মনে পড়ল দিলীপদার মা—র কথাটা, ‘বাবা দেখবে তো? ছেলেটা দিনদিন কীরকম মনমরা হয়ে যাচ্ছে।’ বুড়ির নাতির জন্য কাজ কোনোদিনই সে খুঁজে দেখার সুযোগ আর পাবে না, বুলির জন্যও নয়। কিন্তু সেকথা বললে এই আধপেটা থাকা দুই বাচ্চচার মা বিশ্বাস করবে কি? বুলি তাকে হৃদয়বান মনে করেছে বিস্কিট আর টফি পেয়ে। তার মুখের দিকে বুলির তাকিয়ে থাকাটায় সে অস্বস্তি পেতে শুরু করল।
‘কলকাতায় তো ছেলে সমেত কাউকে কাজে রাখবে না।’
‘ওদের এখানে দাদার বাড়িতে রেখে যাব, মাসে মাসে টাকা পাঠাব।’
‘আচ্ছা, খোঁজ পেলে বলব। …মন্তা, মা এলে নতুন পাতা দিয়ে এক গেলাস চা করে দিতে বোলো।’ এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। এবার থেকে বুলিকে এড়িয়ে চলতে হবে। সে বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
‘জেঠু, আপনি আমার সঙ্গে খেলবেন?’
‘মা—র সঙ্গে খেলো।’ সে পিছনে না তাকিয়েই বলল। দোতলায় এসে জানালাটা খুলে দেখতে পেল, লুডো পেতে মন্তা একাই খেলছে। সে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
আধঘণ্টা পরে সে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেয়ে উঠে বসল। কে হতে পারে? কিছুক্ষণ আগে সে পারুলের গলা শুনেছে। চা করে কাউকে দিয়ে পাঠিয়েছে!
‘কে?’
‘আমি মন্তা।’ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, ঘরে ঢোকেনি।
‘কি ব্যাপার, ঘরে এসো।’
মন্তার খালি গা, পরনে পুরোনো প্যান্টটা। হাতে লুডো, গেঞ্জির প্যাকেট আর টফির ঠোঙা। সে শুধু তাকিয়ে রইল।
‘মা বলল এগুলো ফিরিয়ে দিতে।’ মৃদু স্বরে মন্তা বলল। চোখ দুটো নামানো।
‘কেন?’
‘জানি না। …নিয়েছি বলে মা মারল।’
একটা আগুন দপ করে জ্বলে উঠল তার মাথার মধ্যে। প্রায় লাফিয়েই বিছানা থেকে নামল, চমকে ওঠা মন্তা তাড়াতাড়ি সরে যেতে গিয়ে টলে পড়ল। সে ভ্রুক্ষেপ না করে সিঁড়ি দিয়ে দুড়দাড় করে নেমে গেল। তার মাথার মধ্যে এখন উত্তপ্ত ধোঁয়া, তার যাবতীয় বোধ পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। …অপমান! একটা বাচ্চচা ছেলেকে দেওয়া তার স্নেহ পারুল পায়ে চটকে দিল… কেন, কেন?
উনুনে একটা বাটিতে গরম জল ফুটছে। পারুল উবু হয়ে বসে। কাচের গ্লাসে দুধ—চিনি, ঠোঙাটা থেকে একটা টিনের কৌটোয় চা ঢেলে রাখছে। বুলিকে সে দেখতে পেল না।
‘আমি মন্তাকে দিয়েছি। তোমার এত সাহস যে ওগুলো ফেরত পাঠিয়েছ?
পারুল অচঞ্চল, মুখে বিরক্তি। ‘কোনো কিছু আমার ছেলেকে দেবেন না।’
‘দিলে কী হয়েছে?’ সে চিৎকার করল।
‘অত কৈফিয়ত আমি দিতে পারব না। আমার ছেলেকে আমি নিতে দোব না।’ পারুলের স্বরে পালটা উত্তেজনা নেই। সাঁড়াশি দিয়ে বাটিটা নামিয়ে এক চামচ চা গরম জলে দিয়ে একটা রেকাবি ঢাকা দিল। ধীরে ধীরে কাজগুলো করল।
এগুলো ওর স্পর্ধা দেখানো! উপেক্ষা করা!
‘তুমি জান আমি কে?’
পারুল মুখ তুলে তাকাল, চোখে বিস্ময়।
‘এই সব কিছুর মালিক আমি…সব কিছুর, জমিজায়গা, বাড়ি সব কিছুর।’
‘আমারও?’
‘হ্যাঁ তোমারও। যতদিন আমার জায়গায় থাকবে ততদিন। …তুমি আমার আশ্রিত, তোমাকে দয়া করে, এখানে থাকতে দেওয়া হয়েছে। আমাকে অপমান করার কোনো অধিকার তোমার নেই।’
‘যান যান।’ পারুল উঠে দাঁড়াল তার দশাসই দেহ নিয়ে। কচুবাগান বস্তির স্বর তার গলায়। ‘অধিকার দেখাচ্ছেন, অধিকার! কে আমার অধিকারীমশাই এলো রে অধিকার ফলাতে! এখানে আমায় রেখেছে বউদিমণি। আজ বিশ বছর এখানে বাস কচ্ছি। বউদিমণির দয়ায় তো আপনি এখানে থাকতে এসেছেন। বাড়িতে তো জায়গা জোটেনি, সব খবর আমি রাখি, আমাকে আবার দয়া দেখাচ্ছে! ফুটুনি অন্য জায়গায় মারবেন। সারা রসপুর মৌজার লোক পারুল বিশ্বাসকে চেনে খুন—হওয়ার বউ বলে। উনি এয়েচেন কিনা আমার মালিক হতে!’
একটানা কর্কশ স্বরে পারুল কথাগুলো বলে ঝপ করে বসে পড়ল। তার বড়ো বড়ো চোখ থেকে আগুন ঝরছে, বুক ওঠানামা করছে। বাটি থেকে গ্লাসে চায়ের লিকার ঢালতে লাগল। সে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে পারুলের মুখের দিকে। হাত—পা কাঁপছে, ক্রোধে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে সে। চোখের সামনে যা কিছু ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে শুরু হয়েছে। দুটো রগ দপদপ করছে। …শ্রীগোপালেরও এমন হয়েছিল।
.
‘রোঘো, আজ থানার লোকগুলো এত অপমান করল যে মাথা খারাপ হয়ে গেছে, অথচ মাসে মাসে ওরা আমার কাছ থেকে টাকা খায়। …বরুণ এই তল্লাটের উঠতি নেতা, পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা চেয়েছিল, দিইনি। এখন পুলিশ দিয়ে শোধ নিচ্ছে, আমার ব্যাবসা লাটে তোলাতে চায়। আমি যখন রাজনীতি করি বরুণ তখন হাফপ্যান্ট পরে, থানা এখন ওর কথায় ওঠে বসে।’ কথাগুলো বলে শ্রীগোপাল দেয়ালে ঠেস দিয়ে গুম হয়ে বসে ছিল। দোতলার ঘরের বিছানায়। কোলে দু—হাতে ধরা প্রায় পূর্ণ মদের বোতলটা।