‘একটু আগে বিভূতি ফাটিলাইজারসে আপনার কথা কানে আসছিল।’
‘আপনি তো চা কিনছিলেন।’
‘আমার নিজের খুব চাষের ইচ্ছে, অল্প কিছু জমি আছে কিন্তু চাষবাস সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। আপনার কথা শুনে মনে হল, আপনি অনেক জানেন, নিজে চাষ করান।’
‘হ্যাঁ, বিঘে পনেরো আছে।’
‘আপনি আমায় সাহায্য করবেন পরামর্শ দিয়ে?’
সে নিজেই বুঝতে পারল তার চোখে, গলার স্বরে আবেদনের মতো কিছু একটা ফুটে উঠেছে। লোকটির মুখ ভারিক্কি হয়ে উঠল। ‘আপনি থাকেন কোথায়?’
‘গোকুলানন্দে।’ বলেই সে সিঁটিয়ে উঠল। এবার অনিবার্য প্রশ্নটা হবে, ‘আপনার নাম?’
‘আপনার নাম, কোন বাড়ি?’
‘দত্তদের বাড়ি, কলকাতায় থাকি।’
লোকটির ভ্রূ কুঁচকে উঠল, ‘পারুল নামে একজন মেয়েছেলে যে বাড়িতে থাকে?…খুন হয়েছিল যে বাড়িতে?’
‘হ্যাঁ। …আমার নাম রাঘবেন্দ্র দত্ত।’
লোকটি মনে করার চেষ্টা করছে। ওর মুখ দেখেই বোঝা যায়, নামটা স্মৃতিকে ঘিরে ওর মাথার মধ্যে ঘুরছে, ভিতরে ঢোকার জন্য একটা ছিদ্র খুঁজছে। নিশ্চয় তাকে আগে কখনো দেখেনি, নামটা হয়তো শুনে থাকবে। রাঘবেন্দ্র লোকটা কে নিশ্চয় পরে জানতে পারবে।
‘আমিই সেই খুনিটা…গোকুলানন্দে থাকব বলে এসেছি।’
লোকটির ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল। তবে দু চোখে ভূত দেখার মতো কিছু না ঘটলেও যথেষ্ট অবাক হয়েছে। এভাবে, ‘আমিই সেই খুনিটা’, পৃথিবীতে ক—টা লোকের শোনার ভাগ্য হয়েছে? ‘আপনিই!’
লোকটি নিজেকে সামলে নিয়েছে। এখন কৌতূহলী হবে। ‘এবার আপনি আমার সম্পর্কে খুব একটা হীন ধারণা করবেন তো?’
‘না, তা করব না। আপনি রিহ্যাবিলেটেড হতে চান, আপনি ক্রিমিন্যাল নন। নিশ্চয় আপনাকে সাহায্য করব।’ লোকটি হাসল। সেই হাসিতে তার বুকের মধ্যে সোঁসোঁ বাতাস বইতে শুরু করল, মেঘ জমে উঠল, বুকের মধ্যে টপটপ বৃষ্টি ঝরে পড়ল, বুকের পাষাণ ভারটা গলে যেতে লাগল।
‘আমি থাকি রাইহাটায়, এই রথতলা মাধ্যমিক স্কুলে ইতিহাস পড়াই… আমার নাম শক্তিপদ হালদার। …আপনার তো এখন বিঘে তিরিশেক ধানজমি রয়েছে।’
‘জানলেন কী করে!’
‘আপনার স্ত্রী যখন জমি বিক্রি করলেন তখন আমি পাঁচ বিঘে কিনেছিলুম। …আপনি যদি লোক দিয়ে নিজে চাষ করান আর হাইব্রিড বীজ, পেস্টিসাইড, রাসায়নিক সারে টাকা খরচ করেন, তাহলে অনেক বেশি রিটার্ন পাবেন। …বাড়ির দিকে যাবেন তো? আমিও যাব। …আপনার ওই পারুল তো চাষিকে লিজ দিয়ে চাষ করায়। অশিক্ষিত চাষি, জমিতে তেমন টাকাও ঢালতে পারে না, ফলনও বেশি হয় না।’ শক্তিপদ কথা বলতে বলতে হাঁটছে, সাইকেলের এধারে সে।
হঠাৎই নিজের মধ্যে এখন একটা প্রবল জোর সে অনুভব করতে শুরু করেছে। কী একটা দপদপ করছে তার শিরা—উপশিরায়। মাথাটা হালকা লাগছে, হাত—পায়ের খিল খুলে যাচ্ছে। অনেক কিছু করা যায়, সে করতে পারে। …’তুই কেন বসা কাজ করবি… স্বাস্থ্য আছে, খাটবার ক্ষমতা আছে’, নিশ্চয়ই আছে। …’সাহস করে এগোলে সবই করা যায়।’ যায়। কিন্তু ভুল জায়গায় সাহস করে এগিয়ে ছিলাম পারুল!
‘আপনি যেকোনো ছুটির দিন আমার বাড়িতে আসুন, কথা হবে। আজ একটু তাড়া আছে। শক্তি মাস্টারের বাড়ি বললে রাইহাটায় যে—কেউই দেখিয়ে দেবে। …আমি চলি।’
শক্তি মাস্টার সাইকেলে উঠে পড়ল। খানিকটা এগিয়ে গেছে তখন সে অস্ফুটে বলল, ‘আসুন, আমি যাব।’
বাড়ি ফিরে দেখল উঠোনে রোগা এক তরুণী। গায়ের রঙ কালো, ময়লা নীল ছেঁড়া শাড়ির ফাঁক দিয়ে সায়া দেখা যাচ্ছে, চোয়ালের হাড় প্রকট। মুখটি মিষ্টি। হাঁসগুলোকে তাড়িয়ে ওদের ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কাঁঠাল গাছের নীচে গোরুটা খোঁটায় বাঁধা।
‘তুমিই বুলি, তাই না?’
মেয়েটি লাজুক হাসল। হাসিটা ঝকঝকে দেখাল সাজানো সাদা দাঁতের জন্য। বুলির দুটো বাচ্চচা, স্বামী পরিত্যক্তা, দুটো বাড়িতে কাজ করে, বয়স তেইশ—চব্বিশ…. ওর ভবিষ্যৎ কী? যদি ও দোতলার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ‘মামি’ না বলত তাহলে? তাহলে পারুল আর একটা ‘শখ’ না মেটার অতৃপ্তিতে সেদিন তিক্ত কটু আচরণ করত না সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত, নেশায় চুরচুর শ্রীগোপালের সঙ্গে।
ঘর থেকে মন্তা বেরিয়ে এসেছে দাওয়ায়। সে ঝুলি থেকে লুডো, গেঞ্জি ও প্যান্টের প্যাকেট আর টফির ঠোঙাটা বার করল। ‘এগুলো তোমার।’ জিনিসগুলো সে বাড়িয়ে ধরল। মন্তা প্রথমেই নিল লুডোর বোর্ডটা। ছকের ঘরগুলো তাকে এত খুশি করেছে যে কথা বলতে পারছে না। সে লক্ষ করল বুলি তাকিয়ে রয়েছে। ঝুলি থেকে বিস্কুটের একটা প্যাকেট বার করে সে এগিয়ে গেল। ‘তোমার।’ বুলি দ্বিধা না দেখিয়ে হাত বাড়িয়ে নিল।
‘মন্তা, তোমার গেঞ্জি আর প্যান্টটা পরে দ্যাখোতো ফিট করে কিনা, না হলে দোকানি বলেছে বদলে দেবে। …তোমার মা কোথায়?’ চায়ের প্যাকেট হাতে নিয়ে সে ঘরের দিকে তাকাল। রথতলায় যাবার সময় সে দেখে গেছে পারুল ঘরে ছিল।
‘মা ঝোড়ো মণ্ডলের বাড়ি গেছে, খড় নিয়েছিল এখনও টাকা দেয়নি। এখুনি আসবে।’
‘চায়ের প্যাকেটটা রেখে দাও, মাকে দিয়ো। যাও এগুলো পরে এসো।’
মন্তা ঘরের মধ্যে চলে গেল। সে দাওয়ায় বসল। বুলি হাঁসগুলোকে বাঁশের বেড়ার দু—হাত উঁচু খুপরিতে ঢুকিয়ে একহাত চওড়া খোপের মুখটা পাটা দিয়ে বন্ধ করে ভারী একটা গাছের ডালের টুকরো টেনে আনল।