সামাজিক চেতনায় গত কুড়ি বছরে যদি কিছু বদল হয়ে থাকে তা হলে সেটা ওই ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন ঔদাসীন্য’টার বেড়ে যাওয়া। সোমনাথ হোর বলছেন : ‘পঞ্চাশের মন্বন্তরের যে ক্ষত, যুদ্ধের যে অমানবিকতা, ছেচল্লিশের দাঙ্গার বীভৎসতা—এগুলি আমার আঁকার পদ্ধতিতে খোদিত হয়ে যাচ্ছিল, আমার অজানিতে।… দুর্ভিক্ষের ছবির যে খড়ি হাতের আঙুল পেরিয়ে হৃদয়ে যে দাগ কেটেছিল, তার দাগ আর মিলাল না।’ জীবনকে ভালোবাসলে, অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা থাকলে হৃদয়ে দাগ কেটে যাওয়া দাগ সৎ ও খাঁটি শিল্পী কখনও মিলিয়ে যেতে দিতে পারেন না। উনি চল্লিশের দশকের পোড় খাওয়া মানুষ। দাগটা রেখে দেওয়ার দায় উনি বহন করে চলেছেন।
তারপরও অনেক দশক এসেছে ও চলে গেছে কিন্তু হৃদয়ে দাগ কেটে দেওয়ার মতো কোনো মন্বন্তর, কোনো যুদ্ধ বা কোনো বীভৎস দাঙ্গা, এমনকি ছিন্নমূল মানুষের বন্যা পশ্চিমবঙ্গ আর দেখেনি। গত চার দশক ধরে ক্রমান্বয়ে অপহৃত হয়ে চলেছে মানবিক মূল্যবোধগুলি, সমাজ চেতনায় ছড়িয়ে গেছে টেনশন, গা—ছাড়া হয়ে পড়েছে ব্যক্তির সঙ্গে তার জগতের সম্পর্ক। মানুষ পড়েছে অবিশ্বাসের শূন্যতার মধ্যে। আধুনিক সময়ের এই আঁচড়গুলো পড়ছে যে সমাজদেহের অঙ্গে সেটা কিন্তু রয়ে গেল চারদশক আগের। এই বাইরের আর ভিতরের মধ্যেকার আমলকে তারা সনাক্ত করতে চাইল। এই দুইয়ের সঙ্ঘাত থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎকে ভাষার মাধ্যমে গল্পে সঞ্চার করার জন্য মাঝে মাঝেই ঝাঁক বেঁধে আন্দোলনে নেমেছেন তরুণরা। সাহিত্যে বাসি হয়ে যাওয়া প্রথাগুলিকে ভেঙে নতুন চেতনার বাস্তবতায় তাঁরা বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন চমকপ্রদভাবে আধুনিক হওয়ার জন্য, বাস্তবকে মুচড়ে মনোমতো করে বানিয়ে, যুক্তির মাত্রা কমিয়ে চমকদার বাক্য সাজিয়ে যাওয়া ছাড়া কিন্তু তাদের কাছ থেকে আর কিছুই পাওয়া গেল না। আধুনিকপন্থীদের হামলার প্রধান লক্ষ্য হয় বুর্জোয়া সমাজ ও মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ। সবেগে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলে প্রথমে একটু পিছিয়ে আসতে হয়। তাই করতে গিয়ে সমাজ—বাস্তবতা থেকে আন্দোলনকারীদের কখন যেন বিযুক্তি ঘটে যায়। আধুনিক রূপে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর তাঁরা বুর্জোয়া বিরোধিতার একই কথার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে থাকেন, তবে একটু অন্য গলায়। সাহিত্য থমকে থাকে একই জায়গায়। তখন আমরা বলি, মনে রাখবার মতো গল্প আর পাচ্ছি না। যশস্বী হওয়ার আগে বাঙালি লেখকরা যে পরিমাণ যত্ন ও পরিশ্রম লেখার জন্য দেন, দুঃখের কথা, পরে আর তা দেন না। আরও দুঃখের কথা, বহু নামী লেখকের দুর্বল রচনা সম্পাদকেরা ছাপিয়ে চলেছেন, যে রকম রচনা কোনো অনামী লেখক লিখলে অবশ্যই অমনোনীত হত। এবং আরও দুঃখের কথা, পাঠকরা দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে সত্যিই উদাসীন।
মতি নন্দী
২৩.১.৯৪
ভালো ছেলে
এক
অনন্তের ক্লাস নাইনের এবং অমরের ক্লাস এইটের এগারো দিন পর অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় বাসে উঠতে গিয়ে শক্তিপদ পিছলে চাকার তলায় চলে যায়। মৃত্যু সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে। হাতে ছিল তাঁর দু—ছেলে অনন্ত আর অমরের জন্য দু—জোড়া চটির বাক্স।
‘যদি ও—দুটো হাতে না থাকত তা হলে শক্তিদা হ্যান্ডেলটা ভালো করে ধরতে পারতেন।’
মাস ছয়েক পর এক সন্ধ্যায় শক্তিপদের অফিসের সহকর্মী অবিনাশ কথাটা বলেছিল তাদের ঘরে বসে। অনন্ত আর অমর পরস্পরের দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিয়েছিল। ধীরে ধীরে পাংশু হয়ে যায় তাদের মুখ। মৃত্যুর তিন দিন আগে শক্তিপদ কয়েক আউন্স উল আর বোনার কাঁটা অনিমার জন্য আর এক বাক্স রং পেনসিল অলকার জন্য কিনে এনেছিলেন। ওরা ক্লাসে উঠেছে ফাইভে আর ফোরে।
শীলা বলেছিল, ‘মেয়েদের দিলে, আর ছেলেরা বুঝি ক্লাসে ওঠেনি?’
অনন্ত আর অমর চোখ চাওয়াচাওয়ি করেছিল।
‘মাকে বল না আমাদের চটি নেই।’ অনন্ত বলেছিল। অমর একটু গোঁয়ার, মুখ আলগা। সে চেঁচিয়েই শীলাকে জানিয়ে দেয়, ‘আমার আর দাদার জন্য চটি চাই।’
সেই চটি কিনে বাসে উঠতে গিয়ে….অবিনাশ তাই বলেছিল, ‘বাক্সদুটো হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল, সামলাতে গিয়ে রড থেকে হাতটা পিছলে গেল।’
‘বাক্স দুটোর কী হল, আমরা তো চটি পাইনি!’ অমর ক্ষুণ্ণস্বরে বলেছিল।
অমরটা বোকা, ওর প্রথম চিন্তাই চটি। ভিড় আর উত্তেজনার মধ্যে নিশ্চয়ই কেউ তুলে নিয়েছিল রাস্তা থেকে। কিন্তু অনন্ত একটা কথাই তখন ভেবেছিল, ‘যদি ও—দুটো হাতে না থাকত’ তা হলে বোধহয় বাবার মৃত্যু হত না।
সেই সময় রেকাবিতে পরোটা আর বেগুন ভাজা নিয়ে অনিমা ঘরে ঢোকে। অবিনাশ আপত্তি জানাবার জন্য রান্নাঘরের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘এলেই যদি এইরকম খাবার দেন বউদি তা হলে কিন্তু আর আসব না।’
‘এ আর কী এমন।’
শীলা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে জানায়।
অবিনাশ তখন প্রায় অভিভাবক হয়ে উঠেছিল। রোজই আসত। সংসারের খুঁটিনাটি ব্যাপারও তার পরামর্শ ছাড়া চলত না। পাঁচজনের পরিবার একসময় তার অনুগ্রহনির্ভর হয়ে চলেছিল।
শক্তিপদর মৃত্যুর দিন শীলার হাতে ছিল বত্রিশ টাকা। মাইনের টাকা শক্তিপদ নিজের কাছে স্টিল আলমারির লকারে রাখত, চাবিও থাকত তার কাছে।
চাবির রিংটা ছিল প্যান্টের পকেটে, হাসপাতালের কেরানি সেটা শীলাকে দিতে অস্বীকার করে। মৃত শক্তিপদর সঙ্গে পাওয়া জিনিসগুলো যেমন রুমাল, নস্যির ডিবে, চটির বিল, চশমার খাপ, মানিব্যাগ, পাঁচটি চাবিসহ রিং আর একটা ডাকঘরের খাম পুলিশের হাতে তুলে দেয়। খামটির এক ধার ছেঁড়া ভিতরে একটা চিঠি। পুলিশের এস আই বলেছিল পরদিন থানা থেকে মৃতের জিনিসগুলো প্রমাণ দিয়ে নিয়ে যেতে।