লেখক এই সব তথ্য জানেন এবং এটাও জানেন এঁরা তাঁর লেখাকে ভালো হয়েছে বললে তিনি প্রতিষ্ঠা অর্জনে সুবিধা পাবেন। তাই গরিব সর্বহারাদের নিয়ে গল্প লেখার সময় তাঁর মনে ভেসে থাকে এক মধ্যবিত্ত পাঠকের চেহারা যিনি সাহিত্য রসাস্বাদনে পটু, বোদ্ধা, হয়তো বা আলোচনা—প্রবন্ধও লিখে থাকেন। লেখক এই শিক্ষিত পাঠকের বোধ ও বুদ্ধির কাছে নিবেদন করেন তাঁর লেখাটিকে। তাঁর গল্পের মানুষরা যদিও দিনমজুর, ছোটচাষি, ভিক্ষুক, বেশ্যা, উপজাতি, বাচ্চচা শ্রমজীবী ইত্যাদি। লেখক কিন্তু কোনোদিনই এঁদের মতো জীবনযাপন করেননি, এঁদের সমস্যার ও ভাবনার ধারে কাছেও তিনি যেতে পারেন না এবং তিনি এঁদের ব্যক্তিমানুষ হিসেবে ততটা দেখেন না যতটা দেখেন সামাজিক শ্রেণি হিসাবে। একটি প্রগতিশীল পত্রিকায় গত দশ বছরের গল্পকারদের নিয়ে একটি সমীক্ষা—প্রবন্ধে দেখলাম বলা হয়েছে, ‘এখানেই পূর্ববর্তী সময়ের গল্প থেকে এই সময়ের এ জাতীয় গল্পের মূল পার্থক্য।’ প্রবন্ধকারের মতে, গল্পকারদের দৃষ্টি সর্বহারাদের ওপর গিয়ে পড়েছে হয়তো বা নকশালবাড়ি আন্দোলনের ঝাঁকুনির ফলে।
আমাদের বাস্তবতাকে বিভিন্ন আমলের লেখকরা নানা ভঙ্গির চাহনি মেলে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছেন। এই চাহনি বা রচনার কাজ করতেই লেখক নিজেকে সংস্কার করেন। সমাজবাস্তবতার বাইরের গড়ন আর তার ভিতরের টানাপোড়েন অর্থাৎ কোনটি প্রকৃত আর কোনটি প্রতিবিম্ব এটা চিনে নিয়ে আলাদা করা বেশ জটিল ব্যাপার। এই টানাপোড়েন, ঘাতপ্রতিঘাত থেকে তৈরি হয় লেখকের অনুভূতি। কিন্তু বাস্তবের মৌল শক্তিগুলির কি কোনো বদল এখন পর্যন্ত ঘটেছে? নকশাল আন্দোলন দেশের ও দেশের মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতার অভাব থেকে তৈরি ভঙ্গিসর্বস্ব এমন এক বিপ্লবীয়ানা, যা তৈরি করতে পারেনি নতুন কোনো বিপ্লবী পথ, গড়ে তুলতে পারেনি আদর্শের জন্য রাজনীতি করার উন্নত কোনো নৈতিকতা। এই আন্দোলন যেভাবে দপ করে উঠেই নিভে গেল, যেভাবে টুকরো গোষ্ঠীতে পরিণত হলো, সর্বোপরি এর নেতাদের মধ্যেই যেভাবে হতাশা ও অবসাদের ছাপ ফুটে উঠতে লাগল, তাই থেকেই বোঝা যায় শুধু এর বহির্বাস্তবতাকে অবলম্বন করে গল্প লিখলে তার পরিণতি ওই আন্দোলনের মতই ব্যর্থ হবে। এই আন্দোলনের ঝাঁকুনি থেকে উৎপন্ন গল্পগুলির কিছু কিছু পাঠকদের তারিফ অর্জন করেছে কিন্তু সেটা মূলতই সমাজের ও রাষ্ট্রের দৃশ্যমান বিশৃঙ্খলাটুকু লেখায় প্রতিফলিত হওয়ার জন্য। ৫৬ বছর আগে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রঙ্গপুর সাহিত্য সম্মেলনে তাঁর ভাষণে বলেছেন : ‘সাহিত্যিক বাস্তব জগতের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তার চিত্র আঁকবেন কিন্তু তাঁর অন্তর্দৃষ্টি যথেষ্ট পরিষ্কার হলে তিনি দেখবেন যে বাইরের জগতে যা ঘটে তার চেয়ে লেখকের মনের জগতে আর এক মহত্তর ব্যঞ্জনাময় বাস্তব আছে।’
মনের জগতের বাস্তবটিকে আবিষ্কারে আমাদের প্রগতিশীল লেখকরা খুব বেশি সফল হতে পারেননি। না পারার একটি বড় কারণ, মানুষকে সামাজিক শ্রেণির প্রতিভূরূপে দেখার তত্ত্ব মেনে লিখতে গিয়ে একটা ছাঁচের মধ্যে ঢুকে যাওয়া। স্বাধীনতা লাভের আগে সারা দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পরাধীনতা ঘোচাবার জন্য একটা একমুখী কর্মিষ্ঠ সদর্থক সমাজচেতনা গড়ে উঠেছিল। ‘মহত্তর ব্যঞ্জনায়’ ভূষিত মানবিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা তখন তৈরি হয়ে ওঠে, ফলে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা সমাজে দানা বাঁধে। এরই সঙ্গে যোগসূত্র রচিত হয়েছিল বহিঃস্তরের আন্দোলনের আর বাঙালি সাহিত্যিকদের কাছে সেইজন্য অন্তর্দৃষ্টিকে সাহায্য করতে সেটাই নোঙরের কাজ করে। ব্যক্তিমানুষকে সদর্থক সামাজিক পটভূমিতে রাখার সুযোগ তখন ছিল। সেই আমলের বহু লেখকের গল্প উপন্যাস আজও পাঠকদের আনন্দ দেয়।
মানুষের অভিজ্ঞতা বিষয়ে যে কোনো ধরনের সত্যে পৌঁছতে হলে শেষ পর্যন্ত শৃঙ্খলার দিকে আসতেই হবে। কিন্তু শৃঙ্খলা সম্পর্কে বিশেষ কোনো ধারণা আঁকড়ে বসে থাকা যায় না। এটা স্থাণু নয়, এটা বদলায়। যেমন বদলায় বিশৃঙ্খলার ধরন। বিশৃঙ্খলার ততটাই বরদাস্ত করি যতটা আমাদের বর্তমান মূল্যবোধগুলির সঙ্গে মানিয়ে যাচ্ছে। মানুষের প্রকৃতি এমনই, নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি বিশৃঙ্খলা সইতে পারে না। পরিমাণটা সহনীয় করতে তখন কল্পনার সাহায্য নেওয়া হয়। কল্পনা তখন শৃঙ্খলা সম্পর্কে মায়াবী পরিমণ্ডল তৈরি করে দেয়। এই পরিমণ্ডলই অন্যতর কোনো উপলব্ধির জন্য পাঠককে উত্তেজিত করায়। কিন্তু যে কল্পনার সাহায্য লেখকরা নেবেন তা কীসের উদ্দেশে ধাওয়া করবে, সেই লক্ষ্যটা স্থির করার জন্য চাই মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা। গত দশ পনেরো বছরের মধ্যে যাঁরা গল্প লিখতে এসেছেন তাঁরা বিশৃঙ্খলার বহিঃস্তরের কিছুটা অল্প পরিসরের মধ্যে দেখতে পেয়েছেন। এটা কিন্তু সমগ্র বাস্তব নয়। পাঠককে অন্য কোনো উপলব্ধিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শুধু ‘অন্তর্দৃষ্টি’ই যথেষ্ট নয়, তাদের কল্পনার বহনযোগ্যতার ক্ষমতাও থাকা চাই। এই দুটি ব্যাপারেই এখন বিরাট ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণ কোনো তত্ত্ব দ্বারা সম্ভব নয়। সম্প্রতি এক বিদগ্ধ গ্রন্থসমালোচক আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে বাংলা কথাসাহিত্যে যথার্থ শিল্পীর সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। এটা যদি বাংলা সাহিত্যের পক্ষে এবং বাংলা সাহিত্যের প্রাপ্তমনস্ক পাঠকের পক্ষে আক্ষেপের কথা হয়, তবে এর চেয়েও আক্ষেপের কথা, এই ঘটনাটি সম্বন্ধে আমরা যথেষ্ট মনোযোগী হতে পারছি না, অথবা এর প্রতি আমরা এক দায়িত্বজ্ঞানহীন ঔদাসীন্য দেখাচ্ছি।’ তিনি বলছেন, ‘মনে রাখবার মতো ছোট গল্পের সংখ্যা যে ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে, এটাও আমাদের আর যথেষ্ট দুঃখ দিতে পারে না।’