গলিটা চওড়া হলেই গাড়িটা জোরে পিছু হটে বড়ো রাস্তায় পড়ল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। অহীনের বউ তখনও সামনের দিকেই তাকিয়ে বসে। তারক ওর ঘোমটা থুতনি এবং কপালের খানিকটা দেখতে পেল। অহীন ট্রামরাস্তার উপর বড়ো ঘর ভাড়া নিয়ে ওষুধের দোকান করেছে। তার মধ্যেই খুপরীতে বসে রোগী দেখে। তারক ভাবল, এখন যদি কল আসে তাহলে ওকে রিকশায় যেতে হবে। তবে বালিগঞ্জ-টালিগঞ্জ থেকে কল আসবে না, অত বড়ো ডাক্তার এখনও হয়নি। ওর মতো হাজার হাজার ডাক্তার কলকাতায় আছে। বড়োজোর হাটখোলা, কুমোরটুলি নয়তো দর্জিপাড়ার লোকেই ডাকবে। পাড়ার লোক ছাড়া কে ওকে ভোট দেবে। পয়সা তো করেছে, তাঁর আনার মিকশ্চার পাঁচ সিকেয় বিক্রি করে। এখন পয়সা ছড়িয়ে যদি ভোট পায়। ভোট চাইতে নিশ্চয় বাড়ি-বাড়ি যাবে। দেখা হলে আগের মতো ‘কিরে তারকা’ বলে ঘনিষ্ঠতা দেখাবে। তখন পাত্তা না দিলেই হল।
গুটি পাঁচেক ট্রামে এবং বাসে ওঠার চেষ্টা করেও তারক পারল না। ন-টা পনেরোর পর থেকেই এই অবস্থা হয়। আজ দেরি হয়ে গেছে আট মিনিট। আর দেরি করা উচিত হবে না। এবারেরটায় উঠতেই হবে, এই ঠিক করে তারক তৈরি হয়ে দাঁড়াল। দুটি স্ত্রীলোকও দাঁড়িয়ে অফিসে যাবার জন্য। ট্রাম আসতেই তারক দরজার হাতল ধরে একটা পা রাখার জায়গা কোনোরকমে করে নিল। ট্রাম ছাড়ার পরমুহূর্তেই স্ত্রীলোক দুটির একজন মরিয়া হয়ে তারকের পায়ের উপর পা রেখে খাবলে ধরল ও ডান হাতটা খিঁচিয়ে উঠতে গিয়েই তারক দেখল, পড়ে যাচ্ছে। বাঁ হাতে দ্রুত স্ত্রীলোকটির কোমর বেড় দিয়ে টেনে ধরল বুকের কাছে। এইভাবে প্রায় এক মিনিট থাকার পর তার মনে হল, হাতটা স্ত্রীলোকটির দেহের এমন জায়গায় বেড় দিয়ে রয়েছে যে, এখন তার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির চার্জ আনা যেতে পারে। তবু তার মনে হল পুরুষ মানুষের মতো কাজই সে করছে।
ভাঙা লাইনের উপর ট্রামটা হোঁচট খেতে খেতে চলেছে। এক পায়ের উপর ভর দিয়ে, এক হাতে হাতল ধরে ও অন্য হাতে একটি দুর্ঘটনা রোধ করতে করতে তারক নিজেকে ঠিক পাঁচজনের একজন হিসাবে এখন ভাবতে পারছে না। অহীনের মোটরের সামনে হাঁটতে হাঁটতে তার যেরকম লাগছিল, এখন এতগুলো লোকের মাঝে একটি স্ত্রীলোকের কোমর ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে ঠিক তার বিপরীত অনুভবই হচ্ছে। একসময় সে ট্রামের ভিতরের লোকদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলল, ‘একটু এগিয়ে যান না দয়া করে, জায়গা তো রয়েছে। এইভাবে একজন মেয়েছেলে কতক্ষণ থাকতে পারে?’
এগোল না কেউই। কিন্তু তারক নিশ্চিন্ত হল তার কর্তব্যটুকু যথাযথ করে যেতে পারায়। কোমর ধরার জন্য নিশ্চয় মনে করেছে না, লোকটা দুষ্টু চরিত্রের। তবুও উৎকণ্ঠিত হয়ে রইল তারক। যদি পিঠটাকে বাঁকিয়ে হাতটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে বুঝতে হবে আপত্তি করছে। কিন্তু হাতটা তুলে নিতেও পারছে না, যদি পড়ে যায়! অবশেষে হাতটা সরিয়ে নেবার প্রথম সুযোগ আসতেই সে হাঁফ ছেড়ে পাশের লোককে বলল, ‘এইভাবে অফিস যাওয়া।’
স্ত্রীলোকটির মুখে কোনো ভাবান্তর ঘটল না দেখে তারক দমে গেল। মনে হল, পাঁচজনের একজনের মতোই যেন তার কথাটা বলা হল। আড়চোখে সে দেখল ব্রেশিয়ারের ফিতেটা ব্লাউজের গলা দিয়ে বেরিয়ে। ময়লা তেল চিটচিটে। কিন্তু মুখখানি পরিচ্ছন্ন। বয়স তিরিশের উপরই হবে। মনে হল অম্বল আছে। তারকের আর মনে হল, পতন থেকে রক্ষার জন্য নিতম্বের পিছনে যে অবরোধ বাম ঊরু দ্বারা রচনা করেছে, সেটি এবার সরিয়ে নেওয়া উচিত। এরপর সে স্পর্শ বাঁচিয়ে আড়ষ্ট হয়ে বাকি পথ দাঁড়িয়ে থাকল। কোনোভাবেই স্ত্রীলোকটির দিকে তাকাল না। শুধু একবার তার মনে হল, ঘাড় ফিরিয়ে চাহনি দ্বারা তাকে কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত ছিল।
ট্রামটা লালদিঘির উত্তর-পশ্চিম কোণে থামবার আগেই তারক নেমে পড়ল! রাস্তা পার হবার জন্য কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হল তাকে। ঘড়ি দেখল। একটা ছেঁড়া পোস্টার চোখে পড়ল যেটা কালও আস্ত ছিল। ‘এ লড়াই বাঁচার লড়াই’ পর্যন্ত রয়েছে। বাকিটা তার জানা-‘এ লড়াইয়ে জিততে হবে।’ সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল হিরণ্ময়ের দাঁড়াবার ভঙ্গিটা। যখন সে বলছিল, ‘আমরা মশাই মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ। শ্লোগান দি, লাঠি খাই আর আন্দোলন করি’ টেবলে বাঁ হাতের ভরে ঢ্যাঙা ছিপছিপে শরীরটাকে ঝুঁকিয়ে রেখেছিল। চুলগুলো কপালের উপর ঝুলে পড়ছে আর ডান হাতে তুলে নিচ্ছিল। ঠিক মনে হচ্ছিল ব্যাট ধরে উইকেটে দাঁড়িয়ে।
‘কিন্তু আপনারা? কখনো লড়াইয়ে নামবেন না অথচ লড়াই করে পাওয়া সুযোগ-সুবিধার ফসল ঠিকই গোলাজাত করবেন।’ চোখের সাদা অংশ ঝকমক করে উঠেছিল। চিবুকটা অহংকারে আর একটু এগিয়ে এসেছিল। যেন হ্যামন্ডের মতো কভার ড্রাইভ মেরে বোলারের দিকে তাকাচ্ছে।
রাস্তা পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারকের মনে হল, হিরণ্ময় হাতের মুঠো দিয়ে টেবলে আঘাত করে ‘ফসল গোলাজাত’ কথাটা বলতে পেরে ভীষণ তৃপ্তি পেয়েছিল। হয়তো খুব অসাধারণ ভাবছিল নিজেকে। পাঁচজনের একজন! একটা পোস্টার দেখে আবার তার হিরণ্ময়কে মনে পড়ল। ‘মহার্ঘ ভাতার সর্বভারতীয় ফর্মূলা চালু করতে হবে।’ বাক্যটি হিরণ্ময়ের ঢ্যাঙা শরীরটার মতোই। ও যদি এখন এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় আর চিৎকার করে শ্লোগানটা বলে তাহলে ক-জন সাড়া দিয়ে বলবে, ‘করতে হবে করতে হবে।’ একজনও না। কারণ অফিসের শ-পাঁচেক লোক ছাড়া কেউ ওকে চেনে না। এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সহ-সাধারণ সম্পাদক। তিন বছর চাকরিতে তিনশো চল্লিশ টাকা মাইনে। ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজারের ঘরে যখন-তখন ঢোকে, সাসপেনশন রদ করতে পারে, ইনক্রিমেন্ট বন্ধ রোধ করতে পারে কিন্তু রাস্তায় ও রামা-শ্যামা।