দেখলুম মা-র মুখ থেকে উৎকণ্ঠা ঘুচে গেল। দেখে ভালো লাগল।
‘আমায় নিয়ে যাবি?’ মুখ ঘুরিয়ে লাজুক হয়ে মা বলল। এই সময় আমার বুকের মধ্যেটা নিংড়ে উঠল, হাত কাঁপল, আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকাতে ভয় করল। বললুম, ‘কোথায়?’
‘তোর খেলা দেখতে। একদিনও তো দেখলুম না।’
ইচ্ছে হলে রূঢ়ভাবে বলি, খেলার তো কিছুই বুঝবে না, তবে দেখে কী হবে। বোকার মতো পাঁচ-ছ ঘণ্টা বসে থাকার কী দরকার। কিন্তু বললুম, ‘এ খেলাটা থাক। পরে একটা খেলায় নিয়ে যাব।’
‘কেন, এটাতেই নিয়ে চল না।’
কথা না বলে দাড়ি কামাতে লাগলুম। জবাব না পেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মা চলে গেল। তখন আয়নাটাকে ঘুঁষি মেরে ভেঙে দিতে ইচ্ছা হয়। দ্বাদশ ব্যক্তি, যে দলের বাইরে, যার কাজ ফেউয়ের মতো দলের পিছনে ঘোরা, যে ব্যাট করতে পারবে না, বল করতে পারবে না, শুধু খাটুনি দিতেই যার ডাক পড়ে, যার কোনো ক্ষমতাই নেই দলকে বাঁচাতে, যাকে কেউ গ্রাহ্যের মধ্যেও আনবে না সেই সাধারণ অতি সাধারণ, দ্বাদশ ব্যক্তি। যে এগারোজনের মধ্যেও পড়ে না তার মা কীজন্য যাবে খেলা দেখতে? গিয়ে দেখবে একজনও তার ছেলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলছে না-টি. সিনহা যতক্ষণ উইকেটে আছে কোনো ভাবনা নেই। কিংবা-সিনহা আউট! এবার তাহলে ইনিংস শেষ।
থুতনি জ্বালা করে উঠতে তারক ব্যস্ত হয়ে আয়নার খুব কাছে মুখ এনে দেখল, লাল সুতোর মতো রক্তের দাগ। নীচে থেকে বঙ্কুবিহারী চেঁচাচ্ছে, ‘কাগজটা পাঠিয়ে দে রে তারক, আমার পড়া হয়নি।’
খবরের কাগজটা খাটের উপর থেকে নেবার সময় তারক আর একবার ছবিটার দিকে তাকাল। বাংলার রঞ্জি ট্রফি দল। পিছনে সাতজন দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যে তারক এক কোণে। দুটো হাত অন্যদের মতোই বুকে আড়াআড়ি রাখা। ছবির তলায় সকলের নাম লেখা। তারকের নামের পাশে বন্ধনীর মধ্যে দ্বাদশ ব্যক্তি কথাটি। ঠিক মাঝখানে চেয়ারে বসে অরুণ মিত্তির। ওর নামের পাশে বন্ধনীর মধ্যে ম্যানেজার লেখা। ছবিটা বাঁধিয়ে মা আয়নার উপরে পেরেকে ঝুলিয়ে দেয়। একতলায় নামার সময় তারক গামছাটা টেনে নিল বারান্দা থেকে। কাগজটা বঙ্কুবিহারীকে দিয়ে সে চান করতে কলঘরে ঢুকল। তখন সে ভাবছে, ছবিটা তো খুলে ফেলতেই হবে। কলি করার জন্য গোটা ঘরের জিনিসই যখন বার না করে উপায় নেই।
দুই
অফিসে বেরোবার সময় দেওয়াল ঘড়িটার সঙ্গে হাতঘড়ি মিলিয়ে তারক দেখল দু-মিনিটের তফাত। কাল ছিল চার মিনিটের। দেওয়াল ঘড়িই গোলমাল করছে। কিন্তু বঙ্কুবিহারী ছাড়া ওটার হাত দেবার অধিকার কারোরই নেই। ঠাকুরদার আমলের ঘড়ি। ওই আমলের একজোড়া হরিণের সিং আর তিনটি পূর্বপুরুষের ছবি সে নিজের ঘরে রেখেছে। সিন্দুকটা বঙ্কুবিহারীর নিজের কেনা। ওর মধ্যে প্রচুর কাগজ আর স্ত্রী এবং পুত্রবধূর গয়না রাখা আছে। কাগজগুলো কীসের তারক তা জানে না। তবে বাড়ির দলিল এবং কোম্পানির কাগজ ওর মধ্যেই আছে সেটা অনুমান করতে পারে। বাড়িটা বঙ্কুবিহারীর নিজের নামেই। ট্যাক্স আর ইলেকট্রিক বিল ওর নামেই আসে। লোকে বউয়ের নামেই বাড়ি করে। মরে গেলে বিধবাকে যাতে ছেলে-বউরা হেনস্তা করতে না পারে তারই রক্ষাকবচ। কিন্তু বঙ্কুবিহারী যেন ধরেই নিয়েছিল তার ছেলে মাতৃভক্ত হবে।
নিজের ঘরের দরজায় তারক তালা দিল। রেণু না থাকলে, এইটাই বঙ্কুবিহারীর নির্দেশ। বেরোবার সময় বঙ্কুবিহারী বলল, ‘দক্ষিণেশ্বর যাবি তো ওবেলা?’
‘হ্যাঁ।’
গলির মোড় ঘুরতেই দেখল নির্মল চাটুজ্যে ব্যাজার মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে। তারক বলল, ‘অফিস যাবেন না?’
‘আর অফিস যাওয়া। কাল রাত্তির থেকে পায়খানাটা বুজে আছে, ধাঙড়টাকে বললুম তো ব্যাটা বলে এক টাকা লাগবে।’
‘তা কাল থেকে চালাচ্ছেন কী করে?’
‘ওই কোনোরকমে ওর ওপরেই। বারো আনা পর্যন্ত দোব বললুম রাজি হল না।’
‘সবাই রেট বাড়াচ্ছে। ওই বা কেন ছাড়ে।’
তারক আর দাঁড়াল না। আর একটা মোড় ঘুরতেই মুখোমুখি হল অহীনের নতুন মোটর গাড়িটার। গলি জুড়ে ওদের দরজায় দাঁড়িয়ে। কেউ উঠবে বোধ হয়। মোটরের ধার ঘেঁষে একটু পথ রয়েছে, তাই দিয়ে গলে যাবে কিনা ঠিক করতে করতে দেখল বাড়ি থেকে অহীনের বউ বেরিয়ে এসে মোটরের দরজা খুলে উঠল। তারক দেখল, বউটির রং ফরসা, একটু মোটা। নীচু হয়ে ওঠার সময় ব্লাউজের নীচে চর্বির থাক পড়ল। দেখেই চোখ সরিয়ে নেয়। কেউ দেখলে কী ভাববে। অহীনের বউ সুন্দরী, বি এ পাশ বলে শুনেছিল। তারকের মনে হল, সুন্দরীই। ডাক্তার স্বামী ভালোই রোজগার করে। ক-বছরের মধ্যেই তো গাড়ি করল। অহীনকে বাড়িতে আনলে আট টাকা ভিজিট দিতে হয়। বিলেত যাবে নাকি এম আর সি পি পড়তে।
মোটরটা সাবধানে পিছু হটছে। তারকও এগোতে লাগল। তার দিকে মুখ করে পাঁচ গজ দূরেই অহীনের বউ বসে। তারকের মনে হল তাকেই দেখছে। পাড়ারই একটা লোক, এই হিসাবেই নিশ্চয় দেখছে। সে যে অহীনের বাল্যবন্ধু, ম্যাট্রিক পর্যন্ত একই সঙ্গে পড়েছে, হাঁটতে হাঁটতে দু-জনে প্রথম গড়ের মাঠ দেখতে যায়, মেয়েদের কোনখান দিয়ে ছেলে হয় তাই নিয়ে দু-জনের একবার তুমুল তর্ক হয়েছিল, এইসব কথা ও জানে না। অহীনও নিশ্চয় বলেনি। বিয়েতে নেমন্তন্নই করেনি। কর্পোরেশন কাউন্সিলার হবার জন্য ও নাকি দাঁড়াবে সামনেরবার। পাড়ার দুর্গাপুজোয় দু-বছর ধরে পৃষ্ঠপোষক রয়েছে।