‘ও তবে কী? কীভাবে কথা বলব!’
রেণুর বিস্ময়ে বিন্দুমাত্র খাদ না পেয়ে তারকের মাথার মধ্যে ঝনঝন করে উঠেছিল। ঘর থেকে তখুনি সে বেরিয়ে যায়। বঙ্কুবিহারীকে সেইদিনই বলে, ‘চাকর-বাকর ক্লাশের কাউকে রাখলেই তো ভালো হত।’
‘ও কি দয়া করে কাজ করে দিচ্ছে?’ দুবেলা খাওয়া-থাকা, হিসেব করে দ্যাখতো কত হয়।’
‘তাহলেও ভদ্রঘরের ছেলে, শিক্ষিতও-‘
সঙ্গে সঙ্গে বঙ্কুবিহারী খেঁকিয়ে উঠেছিল, ‘দিনকাল যা পড়েছে আর ভদ্দরলোক থাকতে হবে না। শিক্ষিতও তো কত দেখলুম। তিনবারে আই এ পাশ করে এখন তুই ওকেই ভাবছিস শিক্ষিত। মোল্লার দৌড় আর কদ্দুরই বা হবে।’
অবশ এবং মাটিতে মিশে যাওয়া তারককে ফেলে চটি ফটফটিয়ে বঙ্কুবিহারী চলে যায়। তারক তখন প্রাণপণে মাটি থেকে ওঠার চেষ্টা শুরু করে। কিন্তু দেবাশিসকে ‘দেবু’ বলা ছাড়া আর উঠতে পারেনি।
তারক মাটিতে ডান পা ঠুকে দেখল ঝিঁঝিঁ একদম নেই। ইঞ্জেকসান নিলে এইভাবেই সেরে যাবে রোগটা, ভাবতে ভাবতে সে কাগজ খুলে আইন-আদালতের খবর বার করল। প্রতিদিনই পড়ে, পড়তে ভালো লাগে।
আজকের প্রথম খবরটা তহবিল তছরুপের। পড়েই বুঝল ক্যাশিয়ারটা অবধারিত জেল খাটবে। পঞ্চান্ন হাজার টাকার বদলে তিন কী পাঁচ বছরের জন্য যদি জেলে যেতে হয়, মন্দ কী! তারক ভাবল, এমন সুযোগ পেলে কিছুতেই সে ছাড়ত না। তবে ফিরে এলে, পাড়ার লোকেরা কী রেণুর বাবা-দাদারা নিশ্চয় খুব ছ্যা ছ্যা করবে।
তারক পরের মামলার খবরটায় চোখ বোলাল। এটাকে অতি বাজে বলে তার মনে হল। একটা মন্দিরের প্রণামীর টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারার ব্যাপার। রিসিভার বসানো হয়েছে। তারক ভাবল দিনে কতই বা প্রণামী জমে যে তার ভাগ নিয়ে আবার মামলা হয়!
পরের মামলাটা খুব ছোট্ট করে বেরিয়েছে। একটি স্ত্রীলোক তার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে-তাকে বিয়ের সাত বছর আগে লোকটি আর একটি বিয়ে করেছে এবং সে বউ এখনও বেঁচে। দুটি ছেলেও আছে। সে কথা গোপন করে অর্থাৎ ঠকিয়ে লোকটা তাকে বিয়ে করেছে। শুনানি মুলতুবি আছে।
এই ধরনের ব্যাপার কী করে লোকটা সাত বছর চালিয়ে গেল? তারক ভেবে দেখল, দুটো সংসার চালাতে লোকটার নিশ্চয় কম করে হাজার টাকা মাসে খরচ হয়। তা ছাড়া সাত বছর ধরে প্রথম বিয়ের কথাটা দ্বিতীয় বউয়ের কাছে লুকিয়ে রাখার জন্য লোকটাকে মারাত্মক পরিশ্রম করতে হয়েছে। এইভাবে জীবনযাপন করে লোকটা সুখে থাকতে পেরেছিল কি? তারকের মৃদু ইচ্ছা হল, এইরকম একটা মামলা রেণুর নামে করতে। ওর পূর্ব স্বামী আছে সেটা গোপন করে বা ডিভোর্স না করেই সে বা ওর বাবা-দাদারা (ছ্যা ছ্যা করা বার করে দোব) বিয়ে দেয়। কিংবা এমন মামলাও তো করা যায়, রেণুর ছেলে (তবে অমু নয়), ছোটোটা যার বয়স এখন দেড় মাস-ওর বিয়ে করা স্বামীর অর্থাৎ তারক সিংহের ঔরসে জন্মায়নি। অতএব বিবাহ বিচ্ছেদ করা হোক।
ভাবতে গিয়ে তারক ক্রমশই উৎফুল্ল হয়ে উঠল। প্রমাণ করতে হবে যে রেণু অসতী। কিন্তু কার সঙ্গে তার অবৈধ যৌন সংসর্গ হয়েছিল আদালত যখন তা জানতে চাইবে লোকটার নাম তো বলতেই হবে! হঠাৎই তারকের মনে হল, সেই লোক দেবাশিস হলে কেমন হয়। কিছুক্ষণ সে হতভম্বের মতো মিস্ত্রির দেওয়াল গাঁথার কাজ দেখল ধাক্কাটা সামলাতে। তারপর লজ্জায় মাথা নামিয়ে কাগজে চোখ রাখল। দেবু সম্পর্কে এইরকম মনে হওয়ার জন্য নিজেকে তার কিছুক্ষণ ধরে খারাপ লাগল।
বারো বছরের নাবালিকার উপর পাশবিক অত্যাচারের খবরটাতেও তারকের বিমর্ষতা কাটল না। একঘেয়ে গল্প। ছোটোবেলায় কাগজে যা পড়েছে এখনও তাই। ওদের বয়স সবসময় বারো। ওরা কিছু জানত না। লোকটা ওকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঘরে এনে দরজা বন্ধ করে কিংবা রিকশায় তুলে নিয়ে কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ধর্ষণ বা বলাৎকার বা পাশবিক অত্যাচার করে। শ্লীলতাহানিও কখনো কখনো লেখা হয়। তবে বয়স্ক মেয়েদের ক্ষেত্রেই শ্লীলতাহানি কথাটা বেশি দেখা যায়। তারপর ওর মা বা পাড়ার লোকেরা পুলিশের সহায়তায় উদ্ধার করে। বাবা-র উল্লেখ কদাচিৎ তারকের চোখে পড়েছে।
গলিতে বঙ্কুবিহারীর চটির আওয়াজ হতেই তারক কাগজটা মুড়ে উঠে দাঁড়াবার আগে চট করে দেখে নিল-‘আসামী বালিকাটির উপর তিনবার পাশবিক অত্যাচার করে।’
‘ইট আসছে। কই কদ্দুর এগোল। অ্যাঁ এতক্ষণে এই হয়েছে।’ বঙ্কুবিহারী মিস্ত্রি খাটাতে বসে গেল। তারক উপরে উঠে এল। দাড়ি কামিয়ে, চান খাওয়া করে ন-টা পনেরোয় তাকে ট্রামে উঠতেই হবে।
দাড়ি কামাবার সময় একটা ব্যাপার তারকের মনে পড়ে গেল।-বছর এগারো আগে একদিন মা বলল, ‘হ্যাঁরে তারক, তোর নামের আগে এটা কী লেখা?’
খবরের কাগজ হাতে মা পাশে এসে দাঁড়াল। ঠিক এইখানে। এইভাবেই দাড়ি কামাচ্ছিলুম। জানি কী লেখা আছে। আয়না থেকে চোখ না সরিয়েই বললুম, ‘দ্বাদশ ব্যক্তি, টুয়েলফথ ম্যান।’
‘তার মানে? তোকে নাকি খেলায় নেয়নি?’
‘কে বলল?’
‘সরলের মা শুনে এল, দত্তদের বাড়ির মেজোছেলে বলছিল।’
বলতে পারতুম বাজে কথা বলেছে। কাগজে নাম বেরিয়েছে বলে হিংসে হয়েছে। তাতে মা খুশিই হত। মাকে খুশি করা সবথেকে সহজ ছিল। কিন্তু তার বদলে বললুম, ‘এগারোজনকে নিয়ে তো দল হয়, কিন্তু কারোর যদি হঠাৎ অসুখ করে কী চোট পায় তাহলে কী হবে? তখন দ্বাদশ ব্যক্তি তার জায়গায় খেলবে। একে কি দলে না নেওয়া বলে?’