অহীন রোগী দু-জনের দিকে মন দিল। পুলকদা অমুর সঙ্গে ভাব জমাতে জমাতে বলল, ‘এটাকে খেলা শেখাবি। তুই তো রঞ্জি ট্রফিতে একবার টুয়েলফথম্যান পর্যন্ত পৌঁছে আর তো এগোতেই পারলি না। নিজে যা পারলি না এইবার ছেলেকে দিয়ে দ্যাখনা করাতে পারিস কি না।’
বললুম, ‘কী করাব ওকে দিয়ে?’
বলল, ‘টিমে ঢোকাবার জন্য তৈরি করা। আসল এগারো জনের টিমে ফালতু হয়ে বল কুড়িয়ে কুড়িয়ে কি ইজ্জৎ পাওয়া যায়? শেষমেশ বরাতে জুটবে তো গালাগাল। মনে আছে রে, হেমু অধিকারীর ক্যাচটা ফেলার পর কী খিস্তি খেয়েছিলি তুই? হারা ম্যাচটাকে জিতিয়ে নিয়ে গেল সেঞ্চুরি করে।’
এর জবাবে বললুম, ‘ইঞ্জেকসান নিচ্ছেন যে হয়েছে কী?’
বলল, ‘আর কী, তোরা তো আমার বিয়ের ব্যবস্থা করলি না, তাই পয়সা খরচ করে ঠিকেবউ জোগাড় করি। তাদেরই কেউ ভালোবেসে রোগ দিয়েছে।’ পুলকদা গলা না চেপে, অপরাধীর ভাব না ফুটিয়ে এভাবে এইসব করা কী করে বলতে পারল ভেবে অবাক লেগেছিল। অহীনকে বিব্রতই দেখাল। সে তাড়াতাড়ি রোগী দেখা বন্ধ রেখে ইঞ্জেকসানের ব্যবস্থা শুরু করল, পুলকদাকে বিদায় করতে।
‘পাড়ার ডাক্তার হলে কত সুবিধে, ফি লাগে না।’ ইঞ্জেকসান নেবার সময় পুলকদা হাসতে হাসতে বলেছিল।
‘আবার যদি হয়, তাহলে ফী চাইব।’
‘দোব।’ গা ঝাড়া দিয়ে পুলকদা উঠে দাঁড়াল। ‘তাহলে ওবেলা ঠিক আটটায় আসছি। থাকবি তো?’
‘যদি না কলে বেরোই।’
‘এই দ্যাখ আবার কী ফ্যাসাদের কথা বললি। আটটার সময় বারো ঘণ্টা যে কাবার হয়ে যাবে। ওষুধের গুণ তো তাহলে কেটে যাবে!’
‘কত তো ডাক্তারখানা রয়েছে, কোথাও থেকে নিয়ে নেবেন। ফুর্তি করতে পয়সা খরচ করেন আর এর বেলা বুঝি গায়ে লাগে।’ অহীনের হেসে বলা কথাগুলোর মধ্যে রাগ ও বিরক্তি মেশানো পেশাদারি ঝাঁঝটা স্পষ্টই কানে বাজল।
পুলকদা গায়ে না মেখে বরং চোখেমুখে ভয়ের ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘ওরে ব্বাপ! কী হয়েছে মশাই, কেন হল, কী করে হল, কোত্থেকে হল-সে এন্তার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। সত্যি বলতে কী এসব উত্তর দিতে গেলে, মাথা গরম হয়ে যায়। অপরিচিত উটকো লোককে প্রাইভেট ব্যাপার কি বলা যায়? তোর কাছে তো এসব ঝামেলা নেই।
‘তা তো নেই, তবে বার বার এসব হয় কেন, সাবধান হতে পারেন না?’
‘দূর দূর, এমন এক সস্তার দাওয়াই বার করে গেছে ফ্লেমিং সাহেব আর আমি কিনা সুখ থেকে বঞ্চিত হই! বিয়ে কর বুঝতে পারবি সব। এই তো তারকাটা ছেলের বাপ হয়েছে ওকেই জিজ্ঞেস করে দ্যাখ, বলো না গো…’
‘আচ্ছা আচ্ছা খুব হয়েছে, এখন আসুন তো।’
বেরিয়ে যাবার আগে পুলকদা অমুর গাল টিপে বলে যায়, ‘টেস্ট খেলতে হবে, বুঝেছ?’
অমুর তখন এক বছর বয়স।
পুলকদা গত বছর আফিম খেয়ে মরে গেছে। কারণটা কেউ জানে না। অহীন বিয়ে করেছে, ছেলেপুলে হয়তো হয়েছে। বিয়েতে নেমন্তন্ন করেনি। করার মতো অতখানি আলাপও এখন নেই। আর না থাকলে গিয়ে বলাও যায় না-অহীন রোগে ধরেছে। ইঞ্জেকসান লাগা।
‘বাবু কে একজন ডাকছে।’
তারক চমকে মজুরটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
‘গলিতে কে একজন ডাকছে অনেকক্ষণ।’
তারক ব্যস্ত হয়ে টুল ছেড়ে দাঁড়িয়ে ধপ করে বসে পড়ল। ডান পা ঝিঁঝিঁ ধরে অসাড় হয়ে গেছে।
‘কে? কাকে চাই, এদিকে আসুন।’ চিৎকার করল তারক।
‘আমি নারান।’
‘দরজা খোলাই আছে, এসো।’ তারক ডান পায়ের পাতায় টোকা দিল। গোটা শরীর ঝনঝন করে উঠতেই সে ভাবল, ইঞ্জেকসান নিলেই যখন সারিয়ে ফেলা যায় তখন আর চিন্তা কেন! প্রফুল্ল চিত্তে সে নারানকে দেখামাত্রই বলল, ‘আমার মনে আছে, মনে আছে। তোমার আবার আসার দরকার ছিল না।’
‘বলেছিলেন মাসের গোড়ার দিকে একবার দেখা করতে।’ নারান নামক বাইশ-তেইশ বছরের যুবকটিকে কাঁচুমাচু দেখাল। তাইতে তারক তৃপ্ত বোধ করল।
‘তুমি বরং আজ দুটো-তিনটে নাগাদ আমার অফিসে এসো। যদি আজই ইন্টারভিউয়ের চিঠিটা বার করে দিতে পারি তাহলে হাতে হাতেই দিয়ে দোব। চেনো তো অফিসটা?’
‘চারতলায়, স্টাফ সেকশান। আমি তো একবার গিয়েছিলাম।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, থার্ড ফ্লোর। তাহলে দুটো-তিনটেয়, কেমন?’
নারান চলে যাওয়ার পরও ঝিঁঝিঁ ছাড়েনি। খানিকক্ষণ বসতে হবে। তাই তারক হাঁক দিল, ‘দেবু, আজকের কাগজটা দিয়ে যাও তো।’
দোতলা থেকে কাগজ দিয়ে গেল দেবাশিস। নদিয়ার এক উদবাস্তু কলোনিতে ওর বাবা মা ভাই বোন মিলিয়ে পাঁচজন থাকে। কলকাতায় সরকারি অফিসে পিয়োনের কাজ করে, খাওয়া-থাকা তারকদের বাড়িতে। বিনিময়ে বাসন মাজা ছাড়া সব কাজই করে অফিস যাওয়ার আগে এবং ফিরে এসে। রেণু থাকলে অবশ্য রাঁধতে হয় না। ওকে বঙ্কুবিহারীই জোগাড় করেছে। এমন ভদ্রলোকের মতো দেখতে, চালচলন মার্জিত, স্কুল ফাইনালও পাশ, তাকে প্রথম উবু হয়ে ঘর মুছতে দেখে তারক অস্বস্তি বোধ করে। রেণু আঙুল দিয়ে আলমারির তলাটা দেখিয়ে বলেছিল, ‘ওর তলাটা যে মোছা হল না। আগে যে লোকটা ছিল তাকে প্রথম দিন যা যা বলে দিয়েছিলুম, ঠিক করে যেত। একদিনও আর ফিরে বলতে হয়নি।’
তারক চোখ টিপে, ভ্রূ কুঁচকে রেণুকে চুপ করতে বলেছিল। রেণু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, ‘কেন?’ দেবাশিস কাজ শেষ করে বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তারক কথা বলেনি।
‘ভদ্রঘরের ছেলে, তার সঙ্গে এ কী ধরনের কথা! ও কি চাকর? কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় শেখোনি?’