‘বললেই তো হয় না, পয়সা লাগবে তো। একটা ঘর মানেই একদিনের মজুরি।’
তারক তাড়াতাড়ি উঠে এল দোতলায়। রান্নাঘরটা দোতলায়ই সিঁড়ির পাশে। আগে একতলায় ছিল। কিন্তু একতলার তিনটি ঘর পাঁচিল তুলে আলাদা করে সাত বছর আগে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। মাসের তিন তারিখে বঙ্কুবিহারী নব্বই টাকা পায়। ভাড়াটের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। এমনকী প্রায় এক মাস ওদের কারোর মুখ পর্যন্ত দেখেছে বলে তারকের মনে পড়ে না। তারকদের এখন গলির মধ্য দিয়ে পিছনের দরজাটাকেই সদর হিসাবে ব্যবহার করতে হয়। আবার একঘর ভাড়াটে বসিয়ে একতলার একমাত্র ঘরটিকেও লোপাট করার সিদ্ধান্ত যখন বঙ্কুবিহারী নেয়, তারক খুবই আপত্তি তুলেছিল মনে মনে। শুধু বঙ্কুবিহারীকে একবার বলে, ‘বাইরের লোকজন এলে বসবার একটা ঘর ছিল। সেটা আর থাকবে না।’
সঙ্গে সঙ্গে বঙ্কুবিহারী খেঁকিয়ে উঠে বলেছিল, ‘বাইরের লোকজন কত যেন আসছে। আছে তো তোর শ্বশুরবাড়ির লোক। তাদের ওপরের ঘরে এনে বসানোও তো যায়। বউমার আবার সন্তান হবে, খাবার আর একটা মুখ আসছে, আয় বাড়ানোর কথা ভাবতে হবে না? বছর বছর ক-টাকাই বা তোর মাইনে বাড়ে। দিনকাল কি পড়েছে সে হুঁশ আছে? এখন এক টাকা আশিতে চাল বিকোচ্ছে যখন পাঁচ টাকা হবে তখন ওই ক-টা মাইনের টাকায় কি বাপু চালাতে পারবে? যদি বলিস পারব তাহলে বৈঠকখানা থাক, বাইরের লোকজন আসুক তাকিয়া ঠেস দিয়ে গল্পগুজব কর।’
বঙ্কুবিহারী মিটমিট করে তাকিয়েছিল। তারক কথা না বলে নিজের ঘরে এসে ঢোকে। রেণু যেন ওৎ পেতেই ছিল।
‘এসব নিয়ে তুমি কেন বাবার সঙ্গে কথা বলতে গেছ। ওঁর বাড়ি, উনি যা খুশি করবেন, তাতে তোমার কী?’
‘যা বোঝনা, তা নিয়ে কথা বোলোনা। বাইরের লোককে কেউ শোবার ঘরে এনে তোলে না, ওসব তোমাদের বাড়িতেই চলে।’
‘বেশ তো তোমাদের বাড়িতে নয় এসব চলে না, তাই বলে আমার বাপের বাড়িতে ভাড়াটে বসানোরও দরকার হয় না। বাবা এইমাত্র যা বলল, তা মনে করে দেখ।’
তারক শুধু তাকিয়ে রইল রেণুর দিকে। পোয়াতির পেট এবং পাছার মধ্যে লাথি কষাবার উপযুক্ত কোনটি, কয়েক মুহূর্তের জন্য সেই স্থান নির্বাচনের সমস্যায় সে পড়ে গেল। কিন্তু এই সমস্যাটার মতো বহু সমস্যাই তার মনে ইতিপূর্বে দেখা দিয়ে অসমাধিতই রয়ে গেছে। এটিরও তাই হল। শুধু ঝনঝন করে মাথার মধ্যে একটা রেশ বেজে চলল।
ঘরে বসে তারক সেই রেশটা এখন অনুভব করল হঠাৎই। কলঘরে যাওয়ার দরকার কী, ঘরের দরজা বন্ধ করে দেখে নিলেই তো হয়! রাস্তার দিকে খোলা জানলা দুটোর দিকে সে তাকাল। পর্দাটা টেনে দেওয়া হয়নি, সামনের বাড়ির সুধাংশুদের ঘর থেকে এঘরের সবই দেখা যায়। জানালাগুলো বন্ধ করে দিতেই ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল। তখন সে আলো জ্বালল এবং সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত লজ্জা তাকে পেয়ে বসল।
পঁচিশ-তিরিশ বছর আগে হলে তার কোনোরকম সংকোচই হত না। কিন্তু এই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে এইভাবে বন্ধ ঘরে আলো জ্বালিয়ে এমন একটা ছেলেমানুষি কাজ করতে গেলে যে তার চোর-চোর ভাব দেখা দেবে সেটা তারক বুঝতে পারেনি। মোটামুটি নিজেকে নিয়ে তার হাসি পেয়ে গেল। এমন সময় লজ্জার ওপাশে বঙ্কুবিহারীর গলা শুনতে পেল। তাকে ডাকছে। তাড়াতাড়ি জানালাগুলো খুলে দিয়ে, আলোটা নিভিয়ে তারক দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
‘দরজা বন্ধ করে কী কচ্ছিলি?’ বঙ্কুবিহারী ভ্রুকুটি করল।
‘কিচ্ছু না।’ থতমতো হয়ে তারক একটা কারণ আবিষ্কারের জন্য চারধারে তাকাল।
‘বউমাকে কখন আনবি, রাত্তিরে?’
‘অফিসের পর যাব।’
‘তাহলে রাতে খেয়েই তো আসবি। ইটের দোকানে যাচ্ছি, যাবার পথে গয়লাকে বলে যাব, কাল সকাল থেকেই যেন দেড়সের করে দেয়। বউমাকে বলে দিস, আসার সময় বাচ্চচা দুটোকে যেন দুধ খাইয়ে আনে। নীচে গিয়ে একটু দাঁড়া, আমি দশ মিনিটের মধ্যে ঘুরে আসছি।’
বঙ্কুবিহারীর সঙ্গেই একতলায় নেমে এসে তারক রান্নাঘরের দেওয়াল তৈরির কাজ তদারক করতে দাঁড়িয়ে থাকল এবং বঙ্কুবিহারী হঠাৎ ফিরে আসবে না ধরে নিয়েই সে গত এক ঘণ্টার মধ্যে তৃতীয়বার কলঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল।
আর সঙ্গে সঙ্গে চার বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ল তারকের। তাইতে আর ইচ্ছা করল না কলঘরে ছেলেমানুষ হতে। বেরিয়ে এসে টুলে বসল, বসে মনে করতে চেষ্টা করল-সেদিন অমুকে নিয়ে বাবার সঙ্গে খিটিমিটি হয়েছিল। ছেলের কাশি হচ্ছে দু-দিন ধরে অথচ ডাক্তার দেখাচ্ছি না, এই নিয়ে বাবা এন্তার কথা বলে। তখনই ঠিক করি অহীনকে গিয়ে দেখিয়ে আসব। গেলাম অমুকে নিয়ে। গিয়ে বসেছি মাত্র, তখন-
‘আবার রোগে ধরেছে ডাক্তার, ইঞ্জেকসান লাগাও।’ পুলকদা চেঁচিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে অহীনের ডাক্তারখানায় ঢুকল। হাতে পেনিসিলিনের শিশি আর ডিস্টিল ওয়াটারের অ্যাম্পুল। কয়েকজন রোগীও সেখানে ছিল।
‘আপনাকে নিয়ে আর পারা যাবে না। এই নিয়ে কবার হল?’ অহীন যথাসম্ভব গম্ভীর হবার চেষ্টা করতে লাগল। দু-বছর হল পাশ করে, বাড়িতেই ঘর সাজিয়ে বসেছে। হাফপ্যান্ট পরে যখন ও গলিতে ক্যাম্বিস বল খেলত, পুলকদা রেফারি হত।
অহীনের কথাগুলো যেন শুনতেই পেল না পুলকদা, অমুর দিকে তাকিয়ে আমায় বলল,-‘তারকা এটা কে রে, তোর ব্যাটা নাকি! বাঃ বেশ দেখতে হয়েছে তো। নাম কী রে তোর?’