আজকের বাংলা সাহিত্যে কোনো বৈচিত্র্যে নেই। বিষয়ের এই বৈচিত্র্যহীনতার ফলে সব একঘেয়ে লাগে। তবু এঁদের মধ্যে অনেকেই ভালো গদ্য লেখেন। অনিতা অগ্নিহোত্রী, অমর মিত্র ভালো লিখছেন। এ ছাড়া স্বপ্নময়, ঝড়েশ্বর, সাধন, কিন্নর আমাদের পরবর্তী এইসব নতুন লেখকেরা তাঁদের লেখায় অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো মহান ভাব সঞ্চারিত করে দিয়েছেন, কিন্তু এঁরা প্রত্যেকেই একটা ভাব, একটা নির্দিষ্ট আবেগকেই সম্বল করে যেন আঁকড়ে পড়ে আছেন। কোনো জন্মান্তর নেই। এটাই কি আধুনিক জীবন! যৌনজীবন এখনও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে ট্যাবু হয়ে আছে। তার জন্য হয়তো বাংলা ভাষার দুর্বলতাই দায়ী।
যৌন জীবন, আমাদের শরীরের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম লেখায় প্রকাশ করার মতো ভাষা শব্দ বাংলায় এখনও নেই। বিদেশি ভাষায় আছে, সাহিত্যে আছে। যদি কেউ ভেবে তৈরি করতে পারেন, সেদিনই সাহিত্যে ঠিক ঠিক সম্পূর্ণ জীবন উঠে আসবে। বিদ্যাপতি থেকে ভারতচন্দ্র, এমনকী হুতোমের লেখায় যৌন কথাবার্তা যত স্বচ্ছন্দে উঠে আসে, পরবর্তী কালের বাংলা সাহিত্যে তাও পাওয়া যায় না। ভিক্টোরিয়া রুচিবোধের দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হবার ফলে বাংলা সাহিত্যে তাও পাওয়া যায় না। ভিক্টোরিয়া রুচিবোধের দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হবার ফলে বাংলা সাহিত্য কুঁকড়ে গেল। সম্পূর্ণ জীবন বাংলা সাহিত্যে উঠে এল না।
অনুলিখন : কল্যাণ মণ্ডল
কোরক : শারদ সংখ্যা (শ্রী শতদ্রু মজুমদারের সৌজন্যে প্রাপ্ত)
প্রাসঙ্গিক টীকা
১. কচি হল লেখকের ছোটোবেলার এক মুসলিম বন্ধু। দাঙ্গার সময় ছাদ থেকে লেখক তাকে দেখে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। লেখকের ধারণা কচি তাঁর কাছে সাহায্য চেয়েছিল। এই ব্যাপারটাই ‘কাঁকরের’ মতো হয়ে দাঁড়ায় লেখকের মনে।
২. সময়টা ১৯৫৭ নয়। ১৯৫৬ সালের শেষাশেষি হবে। কারণ, ‘ছাদ’ গল্পটি ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৫ ডিসেম্বর ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয়।
৩. উল্লিখিত কবিতাটির নাম ‘এবারের গরম’। ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নয়। কবিতাটি কবি বিষ্ণু দে-র ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। কবিতাটির প্রাসঙ্গিক লাইনদুটি :
‘হে সমুদ্র হিমালয়! অসহ্য এ শুকনো অবহেলা,
অশ্রু দাও, বৃষ্টি দাও, বেয়ে যাব বেহুলার ভেলা’।
অভীক চট্টোপাধ্যায়
দ্বাদশ ব্যক্তি
এক
সকালে ঘুম থেকে উঠতে তারক সাতটা বাজিয়ে ফেলেছে। আটটার মধ্যে তিনবার সে কলঘরে গেছল।
উঠোনের একধারে, কলঘরের বাইরের দেওয়ালের লাগোয়া নর্দমা পুরুষদের জন্য। প্রথমবার তারক ওখানে গিয়েই বসে। জ্বালা করে ওঠায় ঘাবড়ে গিয়ে সে দেখতে চেষ্টা করে পুঁজ বেরোচ্ছে কিনা। কিন্তু হাতদশেক দূরেই বঙ্কুবিহারী রাজমিস্ত্রির সঙ্গে কথা বলছে টুলে বসে।
কলঘরের ওধারে হাত ছয়েক ফালি জায়গাটায় দেওয়াল তুলে অ্যাসবেসটাসের ছাউনি দিয়ে রান্নাঘর হবে। বৈঠকখানাটার সঙ্গে এই রান্নাঘর পঞ্চান্ন টাকায় ভাড়া নেবে বলে একজন তিনমাসের অগ্রিম দিয়ে গেছে। তারক ভরসা পেলনা বঙ্কুবিহারীর সামনে এইভাবে মাথা নীচু করে দেখার চেষ্টা করতে। হয়তো ধমকে উঠবে-‘অ্যাই কি হচ্ছে ছোটোছেলেদের মতো?’
দ্বিতীয়বার দেখবার চেষ্টা করার জন্য তারক কলঘরের ভিতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। বঙ্কুবিহারী তখন মিস্ত্রিকে নিয়ে ছাদে গেছে, সেখানে রাখা পুরোনো ইটগুলো দেখাতে। কলঘরের ভিতরটা অন্ধকার। তারক ঘাড় হেঁট করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও বুঝতে পারল না পুঁজ বেরোচ্ছে কিনা। তবে টের পাবার জন্য কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে আবার পেচ্ছাপ করল এবং জ্বালা করে উঠতেই বিমর্ষ হয়ে ভাবল,-তাহলে বোধ হয় হয়েছে।
এই সময় গজগজ করতে করতে বঙ্কুবিহারী নেমে আসছে বুঝেই সে তাড়াতাড়ি কলঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল, আর যেন এই নির্মীয়মাণ রান্নাঘরটি ভাকরা-নাঙ্গালের মতো বিরাট এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার, ভঙ্গিটা সেইরকম করে তাকিয়ে থাকল। সিমেন্ট আর বালি মিশিয়ে জল ঢেলে তাগাড় মাখছে মজুরটা। একটা সিমেন্টের ডেলা ছিটকে তার পায়ের কাছে আসতে সেটায় লাথি মারতে গিয়ে দেখল বঙ্কুবিহারী এসে পড়েছে। তারক নীচু হয়ে ডেলাটা কুড়িয়ে তাগাড়ের মধ্যে ছুড়ে দিল।
‘আদ্দেক ইট নাকি চলবে না।’ বঙ্কুবিহারী বিরক্ত হয়ে বলল।
ওকে খুশি করার জন্য অভ্যাসবশতই তারক যথোচিত অবাক হয়ে বলল, -‘কেন, সবগুলোই তো আস্ত রয়েছে!’
‘না বাবু, বেশিরভাগই পচা। কর্নিক মেরে তো দেখলুম ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ছে। আরও পঞ্চাশটা ইট এখনি আনিয়ে দিন।’ মিস্ত্রি বিনীতভাবে বললেও বঙ্কুবিহারীকে চুপ করে থাকতে দেখে তারক বেশি অবাক হবার জন্য আর এগোল না। পঞ্চাশটা ইট কিনে আনতে তাকে দোকানে যেতে হবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত। সস্তায় ভালো ইট কেনার ক্ষমতা ছেলের নেই, সংসারের সাশ্রয় হয় এমন কোনো কাজেরই যোগ্যতা নেই, বঙ্কুবিহারী নিশ্চয় এখন, গত পনেরো বছর যাবত ঘোষিত সিদ্ধান্তটি বদলাবে না।
তারক সিঁড়ির দিকে এগোতেই বঙ্কুবিহারী বলল, ‘বৈঠকখানা চুনকাম হয়ে গেলে যদি চুন বাঁচে তাহলে তোর ঘরটা করিয়ে দোব।’
তারক ঘাড় নেড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে, কী ভেবে ফিরে বলল, ‘একটু বেশি করে চুন গুললেই তো হয়। তোমার ঘরটাও তাহলে হয়ে যায়।’