জগৎসংসারে শিবির কেউ নেই, বাস্তব এই তথ্যটি সম্পর্কে রতন সজাগ ছিল। শিবিকে সে একবারের জন্য জিজ্ঞাসা করেনি তার মার কথা, কোথায় সে থাকে, কীভাবে থাকে, একা না কারুর সঙ্গে, কী কাজ করছে, কত রোজগার করছে। তবে শিবি নিজেই একবার বলেছিল এখন সে বেনেপুকুরে থাকে, পার্কসার্কাসে একটা চামড়ার কারখানায় কাজ করছে।
রতনের ঘরে শিবি যতবারই এসেছে মাঝে মাঝেই চন্দনকাঠের বাক্সটার দিকে সে তাকাত। তার মতে ওটা খুব সুন্দর, ওটাকে রতনের কিছুতেই হাতছাড়া করা উচিত হবে না। লতাপাতা আর আঙুরের থোকা যে কাঠের রঙের সঙ্গে কত মানিয়েছে সেটাও বলত। বাক্সটা তাকে দিয়ে দেবার ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলত। কিন্তু পুরোনো জিনিসের দোকানে বাক্সটা আর দেখতে না চাওয়ার জন্য রতন ইঙ্গিতগুলো না বোঝার ভান করত।
একবার রতন শিবিকে কিছু বেশি টাকা দিতে চেয়েছিল, শিবি কথাটা কানে নেয়নি। তার মনে হয়েছিল বিক্রি করে টাকা পাবার জন্য শিবি বাক্সটা চায় না বা নিজের ঘরে রাখার জন্যও নয়। শিবি চায় পুরোনো জিনিসের দোকানে বেচে দিলে তৃতীয় কেউ ওটা কিনবে তাহলে দুজনের কারুর কাছেই বাক্সটা আর থাকবে না।
অবশেষে শিবি একদিন সোজাসুজিই বাক্সটা চেয়ে বসল। রতন তাকে প্রত্যাখ্যান করল না। আগের মতো হাত দিয়ে মুছে সে যেভাবে দিয়েছিল সেই ভাবেই শিবির হাতে সেটা তুলে দেয়। শিবিকে তখন খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল।
তারপর আবার সেই পুরোনো ব্যাপার। রতন পর দিন পুরোনো জিনিসের দোকানে কৌতূহল নিয়ে গেল। দূর থেকেই দেখতে পেল একটা চামড়ার মেয়েদের ব্যাগ আর নিকেলের ফোটোফ্রেমের মাঝখানে বাক্সটা রয়েছে। রতন আর ওটাকে ফিরিয়ে আনল না। পুরোনো জিনিসের মাঝেই ওটা থাক।
শিবি মারা যায় লরির ধাক্কায়। রাত একটা নাগাদ একটা ট্যাক্সি থেকে নেমে সি আই টি রোড পার হবার সময় ঘটনাটা ঘটেছিল। ফুটপাথের এক বাসিন্দা দেখেছিল ট্যাক্সি থেকে নেমে শিবি টলছিল এবং সেইভাবেই রাস্তা পার হচ্ছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাবার আগেই সে মারা যায়। নাক-মুখ থেকে প্রচুর রক্ত বেরিয়েছিল।
রতন এইসব কথা জেনেছে শিবির এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে। পর পর তিন সপ্তাহ শিবি না আসায় রতন উসখুস করতে শুরু করে। বাক্সটা তাকের উপর না দেখে তার মনে হতে থাকে ওটা ওকে দিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। বাক্সটা দেখার লোভেই ও আসত। একদিন সে পুরোনো জিনিসের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বাক্সটাকে খুঁজল, দেখতে পেল না। কেউ হয়তো কিনে নিয়েছে।
পরদিনই সে বর্ধন প্রেস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে শিবিকে খুঁজতে বেনেপুকুর রওনা হল। শিবি বলেছিল বাস থেকে পুব দিকের গলিতে ঢোকার আগে গলির মুখে পানের দোকান থেকে মিঠে পান কেনে। পানের দোকানের ভিতর চার রকম রঙের কাচের শেড দেওয়া আলো আছে। শেডটা ঘোরে আর চার রকম রং ঝলকায়। বলেছিল আলোর ঝিলিক দেখতে তার ভালো লাগে।
আধ ঘণ্টার চেষ্টায় রতন পানের দোকানটা খুঁজে বার করল। পানওয়ালা বিহারি। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বললে, ‘সেই মেয়েমানুষটা তো লরি চাপা পড়ে মরে গেছে ওইখানে।’ আঙুল দিয়ে একটু দূরের রাস্তাটা সে দেখাল। ‘তা কুড়ি পঁচিশ দিন তো হয়ে গেল। আপনি ওর কে হন?’
‘আত্মীয় হই।’ রতনের ভিতরটা মুহূর্তের জন্য পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হল। পানওয়ালার কাছ থেকে সে জেনে নিল, এই গলিটার মধ্যে বস্তির কোন ঘরে শিবি থাকত।
রতন খুঁজে পেল। অল্পবয়সি রুগণ একটি বউ তাকে জানাল, ‘শিবানীদি তো এই পাশের ঘরেই থাকত।’
সেই ঘরে এখন নতুন ভাড়াটে এসে গেছে।
‘আমরা তো খবর পেলুম পরের দিন সকালে। থানা থেকে লোক এসেছিল খোঁজ করতে। আমরা তো ওর সম্পর্কে কিছুই জানি না। কোনোদিন কাউকে ওর কাছে আসতেও দেখিনি। বলত, কোনো আত্মীয়স্বজন নেই, একা।’
‘ওর কোনো জিনিসপত্তর ছিল না?’
‘জিনিস! ওই রান্নার একটা হাঁড়ি, একটা কড়া, থালা, গেলাস, দুটো শাড়ি। তেমন কিছু থাকার মতো অবস্থা তো ছিল না। রোজগারের সে যে লাইন সে ধরেছিল তাতে বয়স না থাকলে কি আর টাকা কামানো যায়!’
এই সময় বউটির পাশে দাঁড়ানো বছর আটেকের ছেলেটি বলে ফেলে, ‘মা শিবানীমাসির বাক্সটা?’
কড়া চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বউটি বলল, ‘একটা নকশাকাটা ছোটো কাঠের বাক্স ওর ঘরে ছিল সেটা আমি রেখে দিয়েছি, নিয়ে যাবেন তো নিয়ে যান।’
‘কই দেখি।’
সেই চন্দনকাঠের বাক্সটাই। হাতে নিয়ে রতনের মনে পড়ল, পুরোনো জিনিসের দোকানে এটা ঠিকই সে দেখেছিল। কিন্তু তারপর শিবিই এটাকে কিনে নিয়ে গেছে। নিশ্চয় বিক্রির দামের থেকে বেশিই ওকে দিতে হয়েছে।
‘না থাক, এটা রেখে দিন।’ তাদের দুজনের কেউ নয়, তৃতীয় কারুর কাছেই বাক্সটা থাকুক।
এখন রতন রোজ রাতে আলো নেবাবার আগে উপরের তাকের দিকে একবার তাকায়। বউটি বাক্সটা দিতে চেয়েছিল, ফিরিয়ে নেওয়ার দরকার ছিল কী ছিল না, ঘুমিয়ে পড়ার আগে এই জিজ্ঞাসাটা নিয়ে সে রোজই একটু ভাবে। রতন নিশ্চিত, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এর উত্তর সে বার করতে পারবে না।