‘কাজকর্ম কিছু করছ?’
প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবার জন্যই বোধহয় না শোনার ভান করে শিবি চন্দনকাঠের বাক্সটার দিকে চেয়ে রইল।
‘এখন থাকো কোথায়?’
‘এন্টালিতে থাকি।’
ইতস্তত করে রতন বলল, ‘একা?’
‘হ্যাঁ।’ কথাটা বলে শিবি মাথা নামিয়ে রাখল। রতনের মনে হল, ওর জীবনীশক্তির অনেকটাই খয়ে গেছে। চাহনিতে আগেকার ঝকঝকানিটা স্তিমিত। চোখের নীচে চামড়াটা ফোলা। বয়স হয়েছে শিবির।
মাথাটা হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে তুলে শিবি বলল, ‘তুমি সেই আগের মতো মিনমিনেই রয়ে গেছ।’
‘তা রয়ে গেছি।’
‘যদি না রইতে… তাহলে আমরা হয়তো-।’ শিবির গলায় আবেগ নেই।
‘বড্ড দেরি হয়ে গেছে। হইচই ঝগড়াঝাঁটি আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ।’
‘অনেক বই দেখছি।’
‘সময় কাটাতে হবে তো!’
কিছুক্ষণ কেউ আর কথা বলল না। রেডিয়োয় এই সময় খবর হয়, রতন নিয়মিত তা শোনে। আজ সে রেডিয়ো খুলল না।
‘বাক্সটা আমার খুব পছন্দ।’
‘ওটা চাই তোমার? নিতে পারো।’
‘সত্যি সত্যি দেবে!’
‘নিশ্চয়, আমার তো কোনো কাজে লাগে না।’
রতন বাক্সটা তুলে হাত দিয়ে মুছল। ‘এই নাও।’
শিবি বাক্স হাতে নিয়ে উঠল। ‘যাই, পরে আর একদিন আসব।’
‘অবশ্য আসবে, যখন ইচ্ছে হবে।’
ওকে এগিয়ে দেবার জন্য রতন ঘর থেকে বেরোল না। অনেকক্ষণ পর একটা কিউবা ভ্রমণের বই পড়তে পড়তে তার মনে হল শিবিকে তো জিজ্ঞাসা করা হল না, ছেলেপুলে হয়েছে কি না। তারপর মনে পড়ল, ও যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন সে হেসেছিল তখন শিবি আগের মতো ঠোঁট টেপা মুচকি হাসির বদলে যান্ত্রিকভাবে ঠোঁট দুটো টেনে ধরে।
দুদিন পর সকালে রতন লন্ড্রি থেকে কাচানো শার্ট আর ধুতি আনতে গেল। লন্ড্রির গায়েই ভাঙা, পুরোনো নানান শৌখিন জিনিসের দোকান। ফেরার সময় সে দোকানটার দিকে তাকিয়ে ভাঙা বেহালা আর বেতের টেবল ল্যাম্পের মাঝখানে চন্দন কাঠের বাক্সটাকে দেখতে পেল।
প্রায় এক মিনিট সে তাকিয়ে রইল। কী করে এটা এখানে এল! নিশ্চয়ই শিবিই সেদিন ফেরার সময় এখানে বিক্রি করে দিয়ে গেছে। অভাবের তাড়না ছাড়া এমন কাজ করবেই বা কেন, বেচারা! টাকার যদি দরকার তো চাইলেই পারত।
বাক্সটা হাতে নিয়ে রতন বলল, ‘কত?’
দোকানদার তীক্ষ্ন একটা চাউনিতে রতনের মুখটা দেখে নিয়ে বলল, ‘আসল চন্দন কাঠের, পনেরো টাকা।’
দরাদরি করলে কমানো যাবে কিন্তু ইচ্ছে করল না। দাম চুকিয়ে রতন বাক্সটা নিয়ে ফিরল। তার মনে হতে লাগল শিবি আবার আসবে। এবং কয়েকদিন পর সত্যিই এল, একই সময়ে একই শাড়ি পরে। ওর মুখ দেখেই তার মনে হল, শিবি প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত।
‘পাঁউরুটি আর ডিমসেদ্ধ আছে, চলবে?’
শিবি মাথা নামিয়ে কী যেন ভাবল। ‘দাও, কিন্তু তোমার?’
‘এইমাত্র খেলুম। তবে আর এক কাপ চা খাব তোমার সঙ্গে।’ রতন যে মিথ্যা বলল শিবি নিশ্চয় তা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু এই নিয়ে ন্যাকামি না করায় রতন স্বস্তি বোধ করল।
খাওয়ার সময় শিবির মুখের দিকে তাকাবে না ঠিক করেই সে পিছন ফিরে চা করতে বসল। তাকটা শিবির চোখের সামনে, নিশ্চয় এতক্ষণে বাক্সটা নজরে পড়েছে। কিছু একটা ও বলবে নিশ্চয়। রতন চায়ের গ্লাস শিবির হাতে তুলে দিয়ে খাটে বসে ওর মুখের দিকে তাকাল। পাঁউরুটি প্লেটে আর নেই কিন্তু শিবি চিবিয়েই চলেছে। একবার তাকের দিকে চোখ ফেলল কোনো বিস্ময় ফুটল না বাক্সটা দেখে। রতন তাতে একটু হতাশ হল।
‘একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে কাজের ব্যাপারে।’
কাঠের বাক্সটা সম্পর্কে একটা কথাও নয়। ‘কাজ চলছে কেমন?’
‘কাজ নেই ছাড়িয়ে দিয়েছে। ছেঁড়া ন্যাকড়া, কাপড়ের ছাঁট এইসব বাছাই করার কাজ, রোজ ছ-টাকা। শরীর খারাপ হয়ে চার দিন যেতে পারিনি তাই আর কাজে বসতে দেয়নি।’
মাসে শ দেড়েক টাকা। একটা লোক আধপেটা খেয়েও মাস চালাতে পারবে না। রতনের মনে হল শিবি বোধ হয় ফিরে আসতে চায়। যদি চায়, তাহলে সে থাকতে পারে। ও যা মেয়ে, তাতে সোজাসুজিই কথাটা বলে ফেলতে পারে। তবে রতন যেচে ওকে থাকতে বলবে না।
শিবি আবার বাক্সটার দিকে তাকাল। ‘আমাকে দশটা টাকা ধার দিতে পারো?’
‘পারি।’ দড়িতে ঝোলানো শার্টের পকেট থেকে রতন একটা দশ টাকার নোট বার করল। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শিবি কিছু বলল না।
‘সামনের হপ্তায় শোধ করে দোব। ততদিনে কাজ একটা নিশ্চয় পেয়ে যাব।’ শিবি উঠে দাঁড়াল। বাক্সটার দিকে আবার তাকাল। ‘বেশ দেখতে, তাই না? আমার খুব পছন্দের।’
শিবি চলে গেল। পুরোনো জিনিসের দোকানে বাক্সটা বেচে দেওয়া নিয়ে একটি কথাও সে বলল না। এরপর থেকে শিবি প্রায়ই আসতে শুরু করল। …তারা এটা-ওটা নিয়ে কথা বলত, গুরুতর বিষয়ে কখনো নয়। কোনোদিন চুপ করে বসে তারা রেডিয়োয় গান বা নাটক শুনত। রতন কখনো চা তৈরি করত, কখনো করত না। তারা পরস্পরের কাছে খুব সহজ হয়ে গেছিল। একটি আলগা ধরনের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে তারা অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও সান্নিধ্যটা উপভোগ করত। রতনের ধারণা একসঙ্গে এত ভালো সময় তারা আর কখনো কাটায়নি।
ফিরে যাবার সময় কয়েকটা টাকা ধার না নিয়ে শিবি যেত না। রতন প্রতিবারই দিয়েছে কিন্তু ধার কখনোই শোধ হয়নি। তাই নিয়ে সে কিছু মনে করত না কেননা কিছুক্ষণের এই সময়টাকে সে মনে করত খুব শস্তায়ই পেয়ে যাচ্ছে। ধারের অঙ্কটা অবশ্য দশ থেকে পঁচিশ টাকায় উঠেছিল যখন শিবি মারা যায়।