শিবির চলে যাওয়ার দায় তার ঘাড়ে চাপাতে পারে একমাত্র শিবির মা। ওকে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখা উচিত, তাই পরের দিন সন্ধ্যাতেই সে গোলাপ দত্ত লেনে হাজির হল। দরজা খুলে তাকে দেখেই শিবির মার মুখে অস্বস্তি ফুটল।
‘ভেতরে এসো।’ মৃদুস্বরে বলল শিবির মা।
‘না, এইখানে দাঁড়িয়ে বলে যাই। …শিবি কাল আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। একটা চিঠি লিখে বলেছে আর ফিরবে না। কথাটা আপনাকে জানিয়ে গেলুম।’
‘চলে গেছে?’ না প্রশ্ন না বিস্ময় এমন একটা স্বরে কথাটা বলল শিবির মা। রতনের মনে হল কোথায় যেতে পারে হয়তো জানে।
‘তা হলে বোধহয় সত্যচরণের কাছেই গেছে। যাত্রা করে, রোজগারও অনেক। শিবিকে বলেছিল তো যাত্রায় নামিয়ে দেবে। আজকাল মেয়েরাও তো যাত্রা করছে।’
‘যার কাছেই যাক আমার তা জানার ইচ্ছে নেই। …আচ্ছা চলি।’
রতনের জীবনের যে ছকটা গত দু-বছরে গড়ে উঠেছিল সেটা নাড়া খেল শিবির চলে যাওয়ায়। একই ঘরে একটি মেয়ের সঙ্গে বসবাস করার পর তার অভাবটা বোধ হবেই। শিবির চলে যাওয়ার পর খাট সিলিং ফ্যান, কাপড় ঝোলানোর দড়ি থেকে শিলনোড়া, সব কিছুই তার চোখে কিছুদিন অন্যরকম ঠেকেছিল। সে একটা কেরোসিন স্টোভ কিনে নিজের হাতে রান্না শুরু করল। অধিকাংশ দিন সে বাইরে হোটেলেই খায়। অমিয়কে সে এই গৃহত্যাগ সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গও জানায়নি। পাড়ার লোকেরাও টের পায়নি। প্রতিবেশীদের কারুর সঙ্গে পরিচয় নেই, কেউ তাকে জিজ্ঞাসাও করবে না। বাড়িওলার সঙ্গে মাসে একদিন দেখা হয় ভাড়া দিতে গিয়ে। কিন্তু কাশি ঘোষ কখনোই ভাড়াটের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কৌতূহল দেখায়নি। তা ছাড়া যদি কেউ ব্যাপারটা জানতে পারে তা হলে জানুক, জানাজানি হলে সে মোটেই লজ্জায় পড়বে না। আগে হলে পড়ত। তার নিজের ভিতরটা যে পালটে গেছে রতন সেটা বুঝতে পারে। অদ্ভুত একটা নিরাসক্তি তাকে ক্রমশ গ্রাস করে নিয়েছে। জীবন কখনো একরকম থাকে না, এটা সে ধরেই নিয়েছে। নিজে মা কাকাকে ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় সে যা ভেবেছিল এখনও তা বিশ্বাস করে। জীবন অনেক ভাবেই তো বদলায়, শিবির সঙ্গে বাস করাও বদল আবার শিবিকে ছাড়া বাস করাও আর একটা বদল। বরাতে যা আছে তা হবেই। মেনে নিয়ে চলতে হবে নয়তো শান্তি পাওয়া যাবে না।
রতন প্রথম প্রথম ঘরে ফিরে সময় কাটাতে খুবই অসুবিধে বোধ করত। নিজেকে টানতে টানতে একাকী দিন আর রাত কাটানোটা তাকে শিখতে হয়েছে। সে একটা ট্রানজিস্টর রেডিয়ো কিনল আর যতক্ষণ ঘরে থাকে সেটা চালিয়ে রাখে। গান, নাটক, খবর, কথিকা যা কানে আসে তাই শোনে। খবরের কাগজ রাখতে শুরু করল। এমনকী প্রতি রাতে শোবার আগে এখন সে একটা সিগারেটও খায়। মাসের পর মাস বছরের পর বছর রতনের কাছে জীবন এল আর বয়স বাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে, তার ধারণা সে সুখেই আছে। শিবি তার স্মৃতিতে ধূসর হয়ে গেছে।
সময়ের ধুলো স্মৃতি থেকে টোকা মেরে উড়িয়ে দিয়ে এগারো বছর পর এক সন্ধ্যায় শিবি এসে হাজির হল। হঠাৎ ওকে দরজায় দেখে রতন চমকে উঠল। অস্ফুটে বলল, ‘তুমি!’
‘ভূত দেখার মতো যে চমকে উঠলে, আসব?’
‘এসো।’
‘দূর থেকে দেখলুম তুমি সিগ্রেট কিনলে, এখন ওসব খাচ্ছ?’ শিবি ভিতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে রইল।
‘বোসো।’
খাটে না বসে শিবি কাঠের টুলটা টেনে নিয়ে বসল।
‘তুমি দেখছি বদলাওনি, খাটে বসলে না।’
‘বদলাইনি!’ শিবি চোখ বড়ো করে তাকাল। রতনের প্রথমবার দেখা শিবিকে মনে পড়ল। শিবির শরীর বদলেছে, এখন সে মোটা হয়েছে। ফুল লতাপাতার ছাপ দেওয়া কমদামি একটা সুতির শাড়ি ওর পরনে। চুলে চিরুনি পড়েনি, ঘাড় পর্যন্ত চুল ছেঁটে ফেলা। হাতের তেলতেলা মসৃণ চামড়া খসখসে।
শিবিকে দেখে রতন খুশি বা অখুশি কিছুই হল না, তার বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠেছিল। দিনগুলো যতই শিবির সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছে ততই তাদের বিবাহিত জীবন সংকুচিত হয়ে একটা বছরে, একটা মাসে, একটা দিনে, একটা ফুলকিতে পরিণত হয়েছে।
‘কেমন আছ?’ শিবি বলল। ‘অনেকদিন পর।’
‘হ্যাঁ, অনেক দিন পর।’ কথাটা শিবির মতো স্বাচ্ছন্দ্যে সে বলতে পারল না।
‘মনে হচ্ছে ভালোই আছ।’ শিবির কথা বলার ধরন, উচ্চচারণ যে বদলে গেছে এটা রতনের কানে ঠেকল। রাতের জন্য কেনা সিগারেটটা ঠোঁটে লাগিয়ে সে দেশলাই জ্বালাল।
‘দিনে কটা খাও।’
‘একটাই, রাতে খাওয়ার পর।’
‘একা একা ভালোই থাকতে পারো দেখছি।’
‘না পেরে উপায় কী!’ রতনের গলায় বিদ্রূপ নেই। শিবি ভ্রূ তুলল। রতনের নজরে পড়ল ওর ভ্রূ সরু আর ধনুকের মতো বাঁকানো। ঠোঁটে হালকা গোলাপি রং। শিবিকে বয়স্কা মনে হচ্ছে অন্যভাবে। দশ-এগারো বছর আগে ও যা ছিল সেটা আড়ালে রাখার জন্য যেন হালকা ছদ্মবেশে মুখে পরেছে।
শিবি তাকের দিকে চেয়ে রয়েছে। রতন মুখ ফিরিয়ে তাকাল। চন্দন কাঠের বাক্সটা শিবি দেখছে।
‘করছ কী, চলছে কেমন?’ রতন বলল
‘ভালোই আছি।’
আগের মতো শিবি অনর্গল কথা বলছে না। রতন লক্ষ করল কথার মধ্যে চিমটি নেই, স্বরটা চাপা, সাদামাটা। হয়তো এত বছর পরও তাকে এই ঘরে একা দেখতে পাওয়ায়, ঘরের সবকিছু পুরোনো দিনের যেমন ছিল ঠিক তেমনটিই রয়ে যাওয়ায় শিবি নিশ্চয় অবাক হয়ে গেছে। ট্রানজিস্টরটাই শুধু ওর কাছে নতুন।