‘আমার আর দামি জিনিস কী আছে, একটা সোনার গয়নাও তো নেই আর কোনোদিন হবেও না। …প্রেমের চিঠিফিঠি লিখবে কে, লেখার লোক কোথা?’
বাক্সটা তাকে রেখে রতন বলল, ‘লিখতে পারি, পড়ে মানে বুঝতে পারবে তো?’
শিবির মুখ বেঁকে উঠল। ‘লিখতে পারি! মনের মধ্যে প্রেম থাকলে তো!’
এই রকমই উত্তর রতন আশা করেছিল। সে ধরেই নিয়েছে তাদের মধ্যে কটু সম্পর্কটা আর মধুর হবে না। প্রথম দেখার দিন থেকেই সে জেনেছে শিবির মধ্যে পাগলামি আছে। ও সুখী হবার জন্য ব্যস্ত নয়। এক একসময় তার মনে হয়, যতদিন তারা একসঙ্গে থাকবে ততদিন ঝগড়াঝাঁটি চলবে, স্বামী এবং স্ত্রী হিসেবে তাদের জন্য বরাদ্দ সময়সীমা এ বার বোধহয় তারা অতিক্রম করতে চলেছে।
দাম্পত্য জীবনের বিশ্রী ঝগড়াটা একদিন তাদের মধ্যে ঘটে যেতেই রতন বুঝেছিল ভাঙন আসবে। রাতের খাওয়া সেরে বিছানায় চিত হয়ে সে উপন্যাস পড়ছিল। চমৎকার জমাটি গল্প, বুঁদ হয়ে গেছিল বইয়ের মধ্যে। শিবি খাটের পাশে মেঝেয় পা ছড়িয়ে ছুঁচসুতো দিয়ে শাড়ির নীচে ফলস পাড় বসাচ্ছে। হঠাৎ সে বলল, ‘আজকাল তুমি যেন কেমন হয়ে গেছ, সংসারের দিকে আর তাকাওই না। আমার সঙ্গে কথাও আর বলো না।’
রতনের কানে কথাটা ঢুকল না। উপন্যাসে ডুবে গেলে মৃদু স্বরে বলা কথা কানে যায় না। কিছুক্ষণ পর শিবি অধৈর্য স্বরে বলল, ‘কথা কানে গেল কি?’
হাসিমাখা মুখটা বই থেকে তুলে একবার শিবির দিকে তাকিয়েই রতন আবার পড়ায় ডুবে গেল।
‘এত পড়লে চোখ খারাপ হয়ে যায়।’
‘খারাপ হয় না।’ বই থেকে চোখ না সরিয়ে রতন বলল।
‘বাবা বলত শুধু গবেটরাই বই পড়ে, ওদের শিক্ষাদীক্ষার দরকার আছে তো।’
কথাটা রতনের কানে ঢুকতেই মাথাটা গরম হয়ে উঠল। গম্ভীর স্বরে সে বলল, ‘তোমার বাবা কথাটা বলেছেন যেহেতু লেখাপড়া তিনি কখনো করেননি। লেখাপড়া যারা করে, তাদের হিংসে করতেন।’
‘তোমাদের মতো বিদ্যের গোবরপোরা মাথাগুলোদের হিংসে করার কোনো দরকার হয় না। আমার বাবা যা রোজগার করত তার আদ্দেকও তুমি করো না।’
শিবি চিবিয়ে চিবিয়ে শব্দগুলোকে ছিবড়ের মতো করে মুখ থেকে বার করে ফেলল।
‘বই তুমিও পড়তে পারো, অনেক কিছু শিখতে পারবে।’
‘আমার তো ভীমরতি ধরেনি, অনেক কাজ করতে হয় আমাকে।’
শিবিকে খেপিয়ে তুলে বই পড়াটা সে মাটি করতে চায় না। শান্ত গলায় সে বলল, ‘এখন এসব কথা যাক, বলার একটা সময় আছে। বইটা আমায় পড়তে দাও, ক্লান্ত লাগছে।’
‘কী লাগছে? কেলান্ত? ওটা কি শুধু তোমারই জন্য! একটু চেষ্টাচরিত্তির করে দুটো বাড়তি পয়সা রোজগার করো না যাতে বাসন মাজার একটা লোক রাখা যায়। রাস্তায় গিয়ে জঞ্জাল ফেলে যার বউ তার আবার কোনো মানসম্মান আছে নাকি?’
রতন কথা না বাড়াবার জন্য চুপ করে রইল। তাইতে শিবির মাথায় রক্ত চড়ে গেল। হাত বাড়িয়ে রতনের বুকের কাছে ধরা বইটা ছোঁ মেরে তুলে সে বলল, ‘খালি বই আর বই…গাধারও অধম।’ বইটা খোলা দরজা দিয়ে সে গলিতে ছুড়ে ফেলল।
অন্ধ রাগ রতনের চেতনাকে দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে তুলল। লাফিয়ে উঠে বসে সে শিবির গালে চড় কষাল। লাইব্রেরির বই, নষ্ট হলে ছিঁড়ে গেলে ফাইন দিতে হবে। তাই নয়, বইটা ভালো লাগছিল পড়তে, পড়ায় ব্যাঘাতটা তার অসহ্য লেগেছে।
শিবি গালে হাত দিয়ে জ্বালাভরা চোখে তাকিয়ে বলল, ‘গায়ে হাত তুললে!’
এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর শিবির গর্ভপাত হয়। আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। পাড়াতেই ডাক্তার থাকায় রতনকে বেশিক্ষণ দুর্ভাবনায় থাকতে হয়নি। শিবি খাটের বদলে মেঝেয় শুয়ে থাকার জেদ ধরায় ডাক্তার অবশ্য বিস্মিত এবং বিরক্ত হয়েছিলেন।
‘অপদেবতা ঘরে থাকলে এই রকমই হয়… আরও হবে।’ কাতর স্বরে শিবি বলেছিল দাঁত চেপে। রতনের ইচ্ছে করেছিল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। দেয়নি। ভেবেছিল প্রেস থেকে কয়েক দিন ছুটি নিয়ে শিবিকে সঙ্গ দেবে। কিন্তু পরদিন থেকেই সাংসারিক কাজকর্মে ওকে ব্যস্ত হতে দেখে আর ছুটি নেয়নি। শিবি এরপর থেকে একটু বদলে যায়। কথা কম বলতে থাকে। কারণ থাকলেও ঝগড়া এড়িয়ে যায়। তাকে প্রায়ই অন্যমনস্ক লাগে। একদিন রতন দেখল কাঠের বাক্সটা নিয়ে শিবি নাড়াচাড়া করছে।
‘এটা কি পেমপত্তর রাখার জন্য? তুমি কি ঠিক জানো?’ শিবি জিজ্ঞাসা করে। চোখ কৌতূহলে ভরা। ‘এটা যার ছিল সে প্রেম করত!’ নিঃশব্দ হাসিতে ওর মুখ ভরে গেল।
‘প্রেমপত্তরই যে রাখতে হবে তার কী মানে আছে। গয়নাগাটি, টাকাপয়সাও তো রাখা যায়।’
এর মাস দেড়েক পর সন্ধ্যাবেলা প্রেস থেকে ফিরে রতন দেখল ঘরের দরজার একটা কড়ায় তালাটা ঝুলছে, দরজায় শিকল তোলা। এভাবে তালা না দিয়ে শিবির ঘর বন্ধ করে বাইরে যাওয়া আগে কখনো ঘটেনি। ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে সে চারধারে তাকাল। দামি জিনিস কিছু না থাকলেও, পুরোনো গামছাও এইসব পাড়ায় চুরি হয়।
বিছানার উপর চন্দন কাঠের বাক্সটা পড়ে রয়েছে, তুলে নিয়ে রতন ঢাকনা খুলল, ভিতরে একটা কাগজ। হ্যান্ডবিলের পিছনের সাদা দিকটায় শিবি লিখেছে: ‘আমি চিরদিনের মতো তোমাকে ছেড়ে চলে যাইতেছি আর ফিরিব না।’
গোটা দশেক মাত্র শব্দ। হাতের লেখা পাঠশালার পড়ুয়াদের মতো। রতনের চোয়াল কয়েক সেকেন্ডের জন্য শক্ত হয়ে রইল। দীর্ঘশ্বাস পড়ার পর তার স্তম্ভিত ভাবটা কেটে গেল। চিরকুটটা কাঠের বাক্সে ভরে রেখে সেটা সে উপরের তাকে তুলে রাখল। এই রকম কিছু একটা যে ঘটতে পারে ইদানীং সেটাই তার মনে হচ্ছিল। কোনোদিক থেকেই তাদের মধ্যে মনের মিল বা বনিবনা হয়নি। এইভাবে একসঙ্গে বসবাসের থেকে শিবি নিজেই সমস্যাটা মিটিয়ে দেওয়ায় মনের গভীরে রতন ক্ষীণ একটা স্বস্তি বোধ করল। চিৎকার ঝগড়া হল না, জিনিসপত্তর ভাঙা বা ছোঁড়াও হল না, কেমন দিব্যিই সে বিনা ঝঞ্ঝাটে একা হয়ে গেল।