‘কার না কার জিনিস, ফেলে দাও।’ নাক সিঁটকে উঠল শিবির।
‘ফেলব কি! কত কারুকার্য করা, চন্দনকাঠের, এর দাম আছে। থাক এটা।’ রতন হাত তুলে উপরের তাকটায় বাক্সটা রাখল।
‘থলেটা নিয়ে একবার বেরোও। খুঁজে দেখো কয়লার দোকানটা কোথায়। সের দশেক কয়লা ভাঙিয়ে এনো, দশ বারোটা ঘুঁটে চাই। একটা বোতল কিনে কেরোসিন এনো। তারপর মুদির দোকান যেতে হবে। সকালে কেনার সময় হবে না। আজ রাতটা কোনোমতে কাটাই, কালই পাখা ভাড়ার দোকানের খোঁজে বেরোব।’ শিবি উপরে চোখ তুলল। কড়িকাঠে লাগান লোহার হুকটা দেখে বলল, ‘আগের লোকেদের পাখা ছিল।’ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, ‘ঘরটা যেন খাঁচা, বাইরে তাকালেই ইট বার করা দেয়াল দেখতে হবে। আর ঘর পেলে না?’
রতন মৃদু স্বরে বলল, ‘তুমি কিন্তু বলেছিলে, ‘যেভাবে রাখবে সেভাবেই আমি থাকব’, মনে আছে?’
‘বলেছিলুম তো কী হয়েছে?’ ঝাঁঝিয়ে উঠল শিবি। ‘অমন অনেক কথাই লোকে বলে, সব কী ধরে বসে থাকতে হয়। …আমাদের পাকা ছাত ছিল না। কিন্তু ঘরে আলোবাতাস ছিল। যাকগে এ সব বলে এখন আর কী হবে, কপালে যা আছে তাই হবে।’
এই হচ্ছে শিবি, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল রতন। কখনোই সন্তুষ্ট থাকে না। ও সুখী হতে জানে না। ওর কথাবার্তা আচরণ অন্যের মনে কতটা আঘাত করে সেটা বোঝার ক্ষমতা নেই। রতন ভাবল, বোধহয় ভুল করেছি আগাগোড়া। ‘থলে দাও।’ সে উঠে দাঁড়াল।
‘একটা গায়ে মাখা সাবান এনো। চান না করলে ঘুমোতে পারব না।’
রাতে শোয়ার আগে ঘরের আলো নিবিয়ে শিবি শাড়ি, ব্লাউজ, ব্রেশিয়ার খুলে বিছানায় শুয়ে জড়িয়ে ধরল রতনকে। ‘কী মানুষ গা, কাঠের মতো শুয়ে আছ?’ অদূরে গলায় বলল, ‘আজ আমাদের প্রথম রাত না?’
রতন যে ভয়টা করছিল, চারদিন পর সেটা ঘটল। আস্তাকুঁড়ে জঞ্জাল ফেলতে গেছিল শিবি। তখন পাশের বাড়ির দরজায় দাঁড়ানো ধরগিন্নি তাকে দেখে বলে, ‘তোমরা বুঝি নতুন ভাড়া এয়েচ। আগে কোথায় থাকতে? কে সন্ধান দিল ঘরের?’ এইভাবেই আলাপটা শুরু হয়েছিল। মিনিট দশেক তাদের মধ্যে কথা হয়।
বর্ধন প্রেস থেকে বেরিয়ে রতন লাইব্রেরি যায় বই পালটাতে। হেঁটে ফিরে এল সন্ধ্যার পর। পথে মুড়ি আর সদ্য ভাজা বেগুনি কিনেছিল। ঠোঙা হাতে ঘরে ঢোকামাত্র শিবি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর।
‘আমাকে মেরে ফেলার ফন্দি এঁটেচ…তোমার পেটে পেটে অ্যাতো! এই খাটে একটা লোক রোগে ভুগে ভুগে শেষে গলায় দড়ি দিয়ে মরেচে আর সেই খাটে আমায় তুমি শুইয়েচ?…ছি ছি ছি। এখন তো আমায় রোগে ধরবে…তুমি মিটমিটে, সব চেপে গ্যাচো। লেখাপড়া করা ভদ্দরলোক না হাতি।’
রতন ঠোঙা ধরা হাতটা তুলে শান্ত করাবার ভঙ্গিতে বলল, ‘অত উতলা হচ্ছ কেন, ক্যানসার তো ছোঁয়াচে রোগ নয়!’
‘এই ঘরে অপদেবতা আছে জেনেও তুমি ভাড়া নিয়েচ? কুড়িটা টাকা কম হবে বলে লোভ সামলাতে পারলে না? সারা দুপুর বিকেল একা একা আমি এই ঘরে কাটাব?…পারব না, এখানে থাকতে হলে আমি মরে যাব।’ শিবি পাগলের মতো মাথা নাড়তে নাড়তে দু-হাত ছুঁড়ল। হাত লেগে ঠোঙা ছিটকে পড়ে মুড়ি ছড়িয়ে পড়ল মেঝেয়। রতন খাটে বসে পড়ল মাথা নামিয়ে। শিবিকে এখন কিছু বোঝাতে যাওয়া বৃথা।
দেয়ালে ঠেস দিয়ে শিবি মেঝেয় বসে দু-হাতে মাথা চেপে ধরল। ‘মা ঠিকই বলেছিল, সব্বোনাশ হবে। তাই হল, একটা মরা লোকের খাটে কিনা আমায় শুতে হল! কোনোদিন ভূতে এসে গলা টিপে মেরে রাখবে।…এখানে আমি থাকব না, ঘর দ্যাকো।’
সেই রাত থেকে শিবি মেঝেয় শুতে শুরু করল। ওকে সঙ্গ দেবার জন্য সে বর্ধন প্রেস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে থাকল। একদিন বিকেলে ফিরে দেখল দরজায় তালা দেওয়া, সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল। প্রায় আধঘণ্টা পর দেখল শিবি আসছে। রতনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বলল, ‘মায়ের কাছে গেছলুম। তুমি তো ঘর বদলাবে না ঠিক করেচই, দেখি আমি চেষ্টা করে পাই কিনা।’
ঘরে ঢুকে রতন বলল, ‘ঘরের চেষ্টা কি করিনি ভেবেছ? একটু ভালো, ভদ্রভাবে থাকতে গেলে এখন তিন-চারশো টাকার কমে পাওয়া যাবে না, পাঁচ-ছ হাজার সেলামি চায়। কোথায় পাব অত টাকা?’
‘চেষ্টা করেচ? তোমাকে আমি আর বিশ্বাস করব ভেবেচ?…মায়ের কাছে গিয়ে থাকব, কাজকম্মের চেষ্টা করব। রুমালের ব্যবসা ওরা তুলে না দিলে দুটো টাকা রোজগার করতে পারতুম, একটা ভালো শাড়ি কেনার পয়সা জমাতে পারতুম।’
রতন চুপ করে খাটে বসে শুনে গেল। আজকাল শিবি প্রায়ই আক্ষেপ করে। বলে বটে মার কাছে চলে যাব কিন্তু এখনও যায়নি। যেমন সে দিনের পর থেকে ও আর খাটে শোয়নি। রতন ভেবেছিল খাটটা বিক্রি করে দেবে কিন্তু কীসের একটা গোঁয়ার্তুমি তাকে পেয়ে বসল, সে বিক্রি করতে রাজি হয়নি। ক্যান্সার ছোঁয়াচে সংক্রামক রোগ নয় তা হলে কেন সে ভয় পাবে?
শিবি রান্নায় ব্যস্ত হল। রতন আনমনে এধার ওধার তাকাল। উপরের তাকে কাঠের বাক্সটা তার চোখে পড়ল। বাক্সটা পেড়ে সে ফুঁ দিয়ে ধুলো ঝাড়ল। ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে ঘষল। অবশেষে সাবান জল দিয়ে ধুয়ে চন্দন কাঠের আসল রংটা বার করল।
‘বাহ, বেশ সুন্দর তো বাক্সটা!’ শিবি মুগ্ধ চোখে তাকাল। ‘ময়লা জমেছিল বলে বোঝা যাচ্ছিল না। …এতে গয়না রাখত নাকি?’
‘কী করে বলব, কী রাখত! তবে দামি জিনিস, প্রেমের চিঠি এই রকম বাক্সে রাখে।’