‘কত ভাড়া? পাড়াটা কেমন?’
‘সত্তর চেয়েছিল, অমিয়দা বলে কয়ে পঞ্চাশ করিয়েছে, শস্তা না?’
‘না দেখে এখনই বলব কী করে শস্তা কি না! ঘরে রোদ হাওয়া আসে? কলের জল পড়ে কেমন, সরু না মোটা? কাপড় শুকোতে দেওয়ার জায়গা আছে? ছাতে যেতে দেবে তো?’
রতন দু-হাত তুলল শিবিকে থামাবার জন্য। ‘ছাদে যেতে দেবে কি না এখনই আমি কী করে বলব…কত লোক তোমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যাচ্ছে তা জানো?’ রতন কথা ঘোরাবার জন্য বলল।
‘দেখুক।’ আড়চোখে দু-ধারে তাকিয়ে আঁচল টেনে শিবি শরীর মুড়ে ফেলল, ঠোঁট মুচড়ে বলল, ‘দেখার জিনিস তো দেখবেই…শুধু একজনেরই দেখার চোখ নেই।’ তার চোঁটের দু-ধারে অভিমান জমে উঠল।
রতন জীবনে এই প্রথম স্বচ্ছ স্পষ্ট যৌন আহ্বান পেল। শুধু একজনেরই এই দুটো শব্দ তার ভীষণ ভালো লাগল। ‘জানো, একটা পুরোনো খাট ছিল, ডবল বেড, একশো টাকায় কিনে নিয়েছি।’
হঠাৎ খাটের কথা কেন এই সময় তার মাথায় এল! দেখার চোখ যে তার আছে বোধহয় সেটা বোঝাবার জন্যই একসঙ্গে শোয়ার ইঙ্গিত দিতে কি খাটের কথা তুলল। সে লজ্জা বোধ করল। চারধারে এত লোক চলাচল করছে আর তারই মাঝে সে শিবিকে তার সঙ্গে শোয়ার একটা ইশারা দিয়ে ফেলল? রতন অবাক তো হলই মনে মনে কুঁকড়ে গেল।
‘একশো টাকা খরচ করার কী দরকার ছিল? গোটা পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ভালো একটা তক্তাপোশ হয়ে যেত। তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি আর হবে কবে!’
‘কোনোদিনই হবে না।’ রতন হাসার চেষ্টা করল।
‘আমাকে টাকা দাও, জিনিস-টিনিস আমিই কিনব। আগে উনুন কয়লা ঘুঁটে কেরোসিন, হাঁড়ি হাতা-‘
‘থাক, থাক, আর ফর্দ দিতে হবে না। আগে তোশক বালিশ চাদর চাই। ভালো করে শুতে না পারলে এত খাটাখাটুনি করে লাভ কী?’ রতন হালকা সুরে বলল।
‘তুমি একটা কুঁড়ের বাদশা, বেশি বই পড়লে লোকে আলসে হয়।’
‘কী করে জানলে?’
‘বাবা বলত।’
‘এখন আমি লাইব্রেরি যাব বই পালটাতে। রাতে কিছুক্ষণ বইটই না পড়লে আমার ঘুম আসে না, অনেককালের অব্যেস। তুমি এখন দুশো টাকা রাখো, ঘরটা কলি হলেই জিনিসপত্তর কিনে গৃহপ্রবেশ করে ফেলব।’ রতন পকেট থেকে একগোছা নোট বার করল।
‘রাতে আলো জ্বেলে বই পড়বে? ও সব চলবে না, আলো জ্বললে আমি ঘুমোতে পারি না। …বইটই দিনের বেলা পড়ো।’ শিবির মুখে অসন্তাোষ ফুটল।
‘এই দেখো! ঘর করা শুরু না হতেই ঝগড়া শুরু করে দিলে? তোমাকেও বই পড়ার নেশা ধরিয়ে দেব।’
শিবি ঠোঁট ওলটাল। ‘দেখব, কেমন তুমি ধরাতে পারো।’
রতন টাকা গুনে শিবির হাতে দিল। জিভে থুথু লাগিয়ে শিবি আবার গুনল। ‘আমি মানিকতলা বাজার থেকে দুপুরে সব কিনে সোজা চলে যাব। তুমি কোথায় থাকবে? ওদিন আপিসে ছুটি নাও। ঘরদোর ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে…ওহ ঝ্যাঁটা কেনার কথা মনে পড়েনি। রান্না করার টাইম তো সে দিন পাব না, কচুরি খেয়ে রাত কাটাতে হবে। পাড়ার কয়লার দোকানটা দেখে রাখেনি?’
‘এখন তুমি বাড়ি যাও। দুপুর দুটোর সময় মানিকতলা বাজারের পুব দিকের গেটের সামনে থাকব। কেনাকাটা করে রিকশায় মাল চাপিয়ে ঘরে যাব। একদম নতুন জিনিসপত্তর দিয়ে নতুন জীবন শুরু করব।’ রতনের গলায় উদ্দীপনা ফুটল।
‘সব আর নতুন কোথায়, খাটটা তো পুরোনো!’
রতন ঢোঁক গিলল। শুধু পুরোনোই নয়, ওই খাটে শুয়েছে ক্যানসারের রুগি। লোকটা গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে, সে কথা শিবিকে বলা হয়নি। ঘরে ভূত আছে এই রটনার কথাও সে চেপে গেছে। রতন বুকের মধ্যে অস্বস্তি বোধ করল।
‘খাটটা পালিস করিয়ে নিলেই নতুন হয়ে যাবে। …দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে বই নিয়ে লাইব্রেরি যেতে হবে।’ কথাটা বলেই রতন আচমকা হাঁটতে শুরু করল শিবিকে ফেলে রেখে।
নয়
বিকেলে হরনাথ লেনে চব্বিশ নম্বর বাড়ির সামনে রিকশা থেকে দুজনে যখন নামল তখনও পর্যন্ত রতনের শরীর উত্তেজনায় টানটান হয়েছিল। মাকে প্রণাম করতেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিল। তার চোখেও জল এসেছিল। মা ছুটে গিয়ে মেঝেয় আছড়ে পড়ে। সে আর ফিরে তাকায়নি, কাপড়ের ঝোলাটা বগলে নিয়ে ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার আগে শুধু বলেছিল, ‘আমি এসে তোমায় দেখে যাব মা।’
তখন থেকেই শরীরটা তার শক্ত লাগছিল। মাথার মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করতে শুরু করে অনিশ্চিত জীবনে ঢোকার উত্তেজনা, শিবি গলিটার দিকে তাকিয়ে প্রথম কথা বলল, ‘এত সরু!’
কথাটা শুনেই রতনের মনে হল, শিবি সুখী হবে না। তালা খুলে দরজার পাল্লা ঠেলে দিয়ে রতন প্রচুর আশা নিয়ে তাকাল। শিবির মুখে ভাবান্তর দেখতে পেল না। রিকশা থেকে দুজনে হাতে হাতে তোশক বালিস, উনুন, বালতি আর খুচরো জিনিসগুলো নিয়ে এসে ঘরে রাখল। পাশাপাশি আর সামনের বাড়ি থেকে কিছু কৌতূহলী চোখ তাদের লক্ষ করল।
সদ্য কলি হওয়া ঘর ভরে রয়েছে চুনের গন্ধে। রতন জানালা খুলে দিল।
‘কী গরম ঘরটায়! হাওয়াটাওয়া ঢোকার তো উপায় নেই, নাকের সামনেই দেয়াল।’ শিবি আঁচল দিয়ে গলা মুছল।
‘পাখা ভাড়া করতে হবে।’ খাটে তোশক পাতায় ব্যস্ত রতন বলল।
‘মেঝেটা জল দিয়ে ধুতে হবে। রান্নার জায়গাটা দেখি। কলতলাটা কোথায়?’
ওরা ঘর ধোয়ামোছায় ব্যস্ত হয়ে রইল কিছুক্ষণ। খাটের নীচে ঝাঁটা দিয়ে জল টানতে গিয়ে বেরিয়ে এল ঢাকনা দেওয়া এক বিঘৎ লম্বা চৌকো পুরোনো একটা কাঠের বাক্স। শিবি সেটা দেয়ালের তাকে তুলে রেখে মেঝেয় ঝাঁটা ঘষতে লাগল। বাক্সটা চোখে পড়তে রতন, ‘একটা কোথায় পেলে।’ বলে তুলে নিল। ধুলোময়লায় কালো হয়ে আছে। খুঁটিয়ে দেখতেই চোখে পড়ল বাক্সের তিন দিকে লতাপাতা আর আঙুরের থোকা খোদাই করা। কবজা লাগানো রয়েছে ঢাকনাটায়। সে ঢাকনা খুলল। ভিতরটায় ময়লা নেই। কাঠের রং ঈষৎ হলদেটে। কৌতূহলে সে বাক্সটা নাকের কাছে ধরে গন্ধ শুঁকল। হালকা চন্দনের গন্ধ পেল। ‘দ্যাখো, ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই লাভ হল। চন্দন কাঠের বাক্স, গয়নাটয়না রাখা হয়। মার একটা ছিল, দিদিকে দিয়ে দিয়েছে।’