‘অমিয়দা এখন আমি বাড়ি যাই।’ রতন সার্কুলার রোডে পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘এবার তোর প্রেসে যাওয়ার রাস্তাটা আগের থেকে কম হবে, সুবিধেই হল।’
‘তুমি যে উপকার করলে তা আমি জীবনে শোধ করতে পারব না। অমিয়দা কি যে দুশ্চিন্তা ছিল!’ রতন ঝুঁকে (অপ্রস্তুত) অমিয়র পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। ‘ঠিক আছে ঠিক আছে।’ অমিয়র চোখে আবেগ ও স্নেহ ফুটে উঠল। কাঁধ চাপড়ে বলল, ‘বাড়ির আপত্তি সত্ত্বেও অন্য জাতের মেয়েকে বিয়ে করেছিস, মরদের মতো কাজ করেছিস। জাত গোত্তর মিলিয়ে বিয়ে করে শিক্ষিতরা যাদের কলজেতে ক্যানসার…যা যা বললুম বউমাকে সঙ্গে করে সেগুলো বাজার থেকে কিনে নিবি।’
‘নোব। আগে বালব কিনতে হবে, অত কম আলোয় বই পড়া যাবে না।’ ট্রাম রাস্তা পার হয়ে রতন সাহিত্য পরিষদ স্ট্রিট ধরে পশ্চিমে হাঁটতে শুরু করল। শিবিকে আজই খবর দিতে হবে। উত্তেজনায় তার শরীর চনমন করে উঠছে। পনেরো দিনের আগেই ঘর জোগাড় করেছে, এটা কি ওকে বুঝিয়ে দেবে না রতন রায় একটা মেনিমুখো ছেলে নয়! অমিয়দা বলল, মরদের মতো কাজ সে করেছে। রতনের হাঁটার বেগ বেড়ে গেল। এখুনি সে শিবিকে জানিয়ে দেবে।
সদর দরজা খুলল শিবির মা, চোখ কুঁচকে গেল রতনকে দেখেই। ‘কী চাই?’
‘শিবিকে।’
‘তোমার বউকে? ও তোমার বউ নয়, মন্দিরে মালাবদল করলেই সেটা বিয়ে হয় না। …কাটো এখান থেকে, শিবির বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, সত্যচরণের সঙ্গে ওর বিয়ে হবে।’ বলেই শিবির মা দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। শব্দ করে খিল পড়ল।
হতভম্ব হয়ে রতন দাঁড়িয়ে রইল। শিবির আবার বিয়ে হবে! সে ছুটে জানালায় গিয়ে ডাকল, ‘শিবি, শিবি।’
জানলায় এসে দাঁড়াল বিস্মিত শিবির মুখ। ‘কী ব্যাপার!’
‘ঘর পেয়েছি, শিবি ঘর পেয়েছি।’ ফিসফিস করে রতন বলল উত্তেজনা দমন করে। সরে গেল মুখটা। কয়েক সেকেন্ড পর সদর দরজার খিল খেলার শব্দ হল।
‘শিবি কালই অ্যাডভান্স করব ছ-মাসের ভাড়া, এখুনি কথা হয়ে গেছে বাড়িওলার সঙ্গে।’
মায়ের সামনেই শিবি দু-হাতে জড়িয়ে ধরল রতনের হাত। ‘সত্যি!…কোথায় পেয়েছ, কবে যাব?’ রতনকে সে টেনে বাড়ির মধ্যে ঢোকাল। মায়ের দিকে তাকিয়ে শিবি বলল, ‘মন্দিরে বিয়ে করলে সেটা বিয়ে নয়?…ওসব অন্যকে বুঝিয়ো শিবিকে নয়। বাড়ি থেকে আমাকে তো বেরিয়ে যেতে বলেছ, এবার তাই যাব। …বলো কবে যাব?’ প্রশ্নটা রতনকে।
‘আগে সংসারের জিনিসপত্তর কেনা হোক, তারপর তো।’ রতন কথাটা বলে শিবির মায়ের দিকে তাকাল। ওর সামনে সব কথা বলা ঠিক হবে না ভেবে নিয়ে সে শিবির হাত ধরে তাকে বাড়ি থেকে টেনে বার করল। সদরের বাইরে দাঁড়িয়ে সে গলা নামিয়ে তড়বড় করে বলল, ‘অ্যাডভান্স পেলে বাড়িওলা ঘরের চাবি দেবে। তারপর যা যা কেনার কিনতে হবে। কাল সন্ধে বেলায়, সাতটা থেকে আটটা, হ্যাপি গ্রিলের সামনে থেকো। তোমার মার সামনে এ সব কথা বললুম না, তা হলে কী বাগড়া দেবে, কে জানে…তোমার বিয়ে নাকি ঠিক করে ফেলেছে?’ রতনের চোখে মুখে ফুটে উঠল উৎকণ্ঠা।
‘আরে রাখো তো ওসব ফালতু কথা। কোথাকার কোন মুখ্য, মোদো মাতাল…বললেই আমি বিয়ে করব? তাহলে কাল সাতটা-আটটায়? জিনিসপত্তর যা কেনার আমিই কিনব তুমি শুধু টাকাটা দিয়ো।’
‘দোব, এখন চলি।’ রতন ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। শিবি তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে, ভিজে বাতাস লাগানোর মতো আরাম ওর মুখে। চোখ দুটো আধবোজা। পটে আঁকা ছবির মতো নরম ভঙ্গিতে শরীরটাকে আলতো করে দাঁড়িয়ে। মুখে একটা পাতলা হাসি যার একশো রকমের মানে করা যায়। অন্তরের অন্তঃস্থলে গভীর তৃপ্তি রতন বোধ করল। অতীতের জীবন থেকে নিজেকে…ছিঁড়ে ফেলার জন্য তার কোনো খেদ আর রইল না। কয়েক মুহূর্তের জন্য এমন একটা ছবি উপহার পেয়ে যে কৃতজ্ঞবোধ করল শিবির কাছে। এখন পৃথিবীর বলিষ্ঠতম লোক বলে নিজেকে তার মনে হচ্ছে।
‘আমি কিন্তু পনেরো দিনের আগেই-‘ কথা শেষ না করেই রতন বাড়ির দিকে দপদপিয়ে রওনা দিল। সে এখন খুব সুখী। একটা হৃদয় সে জয় করেছে।
পরের দিন পোস্ট অফিস থেকে সে এক হাজার টাকা তুলল। কাজ থেকে ফেরার পথে কাশিনাথ ঘোষকে সে অ্যাডভান্সের তিনশো আর খাটের জন্য একশো টাকা দিয়ে ঘরের চাবি নিল। হ্যাপি গ্রিলের সামনে সে পৌঁছল সাতটায়।
বাসস্টপে ফুটপাথের ধার ঘেঁষে শিবি দাঁড়িয়েছিল বিয়ের সময়ের খয়েরি সিন্থেটিক শাড়িটা পরে। এইটাই ওর সেরা শাড়ি। কপালে সিঁদুরের টিপ, নাকের উপর সিঁদুর গুঁড়ো। সিঁথেয় চওড়া করে টানা সিঁদুর। হাতে শাঁখা আর লোহা। বিবাহিতা, এই ঘোষণা সদর্পে তার অঙ্গে ছড়িয়ে রয়েছে।
‘এই যে চাবিটা।’ রতন কোহিনুর হিরে হাতে তুলে দেওয়ার মতো চাবিটা শিবির দিকে এগিয়ে দিল। বিশ্বাস না করা চোখে ফুটে উঠল বিশ্বাস। শিবিকে সে প্রত্যক্ষ প্রমাণ হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। ‘কালই তুমি চাবি খুলে ঘরে ঢুকতে পারো। তবে পরশু কলি করিয়ে দেবে, তার পরের দিনই যাব।’
‘কোথায় ঘর পেয়েছ, কাছাকাছি?’
‘বড়ো পরেশনাথের মন্দিরের কাছে পাকা বাড়ি, একতলায় একটা ঘর, রান্নার জায়গা। বাড়িওলা কত্তা-গিন্নি ওপরে থাকে, বাড়িতে আর লোক নেই, নির্ঝঞ্ঝাট, আমাদের প্রেসের লাইনো অপারেটার অমিয়দাই ঠিক করে দিয়েছে, কাছাকাছিই থাকে, আমাকে খুব ভালোবাসে। ওদের সদর আলাদা, আমাদের যাতায়াত গলি দিয়ে।’ একটানা সে বলে গেল। শিবির মুখে উত্তেজনা দেখবে ভেবেছিল কিন্তু তার বদলে দেখল শান্ত নরম ছায়া। চাবিটা চোখের সামনে তুলে শিবি হাসল।