রতন বাড়ি ফেরার জন্য উঠে পড়ল। ক্লান্তিতে শরীর যেন ভেঙে পড়বে, অবসন্ন পা, মাথায় দুশ্চিন্তা। ওরা শুনলে কী প্রতিক্রিয়া হবে? বাড়ির দরজা খোলা ছিল। চোরের মতো সে ঢুকল। মা রান্নাঘরে রয়েছে। দোতলায় কিছু একটা নিয়ে ননদ আর বউদিতে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। শোবার ঘরে ঢুকেই রতন শার্টটা খুলে গেঞ্জি পরে নিল। কিছু একটা নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য বহু বছর আগে তরুণ পাঠাগার থেকে আনা ছেঁড়া অভিধানটা খুলে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পাতা খুলতেই চোখে পড়ল: দিগর, দীগর-বিঃ (আদালতী ভাষায়) আদি, প্রভৃতি; অঞ্চল…।
‘এতক্ষণ বাইরে কোথায় ছিলি দুপুর থেকে?’ উমা ঘরে ঢুকেছে।
হাত পা শক্ত হয়ে গেল রতনের। ‘এক বন্ধুর বাড়িতে।’
‘পায়ে আর ব্যথা নেই?’
‘না।’ বলেই অসহনীয় হয়ে ওঠা অপরাধবোধের তাড়নায়, গলাটাকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে, সে বলল, ‘আজ একটা ব্যাপার করে ফেলেছিল মা।’
আড়চোখে সে দেখে নিল মায়ের মুখ। কৌতূহল আর শঙ্কা নিয়ে উমা তাকিয়ে রয়েছে। চোখ বন্ধ করে সে বলল, ‘বিয়ে করেছি।’
ঘরে শব্দ নেই। সে চোখ খুলল না। অনুমান করল অবিশ্বাস মায়ের মুখে ঘুসি মেরেছে। দুমড়ে গিয়ে ব্যথায় অসাড় হয়ে গেছে মুখ।
‘কী বললি!’ কোনোরকমে শব্দ দুটো বেরিয়ে এসেছে উমার মুখ থেকে।
‘হঠাৎই ঘটে গেল, একেবারে আচমকা…ভাবতে আমার কী রকম যেন লাগছে।’
‘কাকে বিয়ে করলি…সেই মেয়েটা?’
রতন ধড়মড়িয়ে খাট থেকে নেমে উবু হয়ে বসে দু-হাতে উমার পা চেপে ধরল। ‘মা আমাকে ক্ষমা করে দাও। …আমি জানি আমি অন্যায় করেছি, তোমরা এ বিয়ে মেনে নেবে না তাও জানি। তোমাদের মাথা হেঁট করে দিয়েছি, আমি বংশের কুলাঙ্গার। কাউকে বলতে পারব না, শুধু তোমাকেই বললুম।’
‘কীভাবে বিয়ে করলি, সই করে?’
‘না। শিবের মন্দিরে শালগ্রাম সাক্ষী রেখে, মালাবদল করে সিঁথেয় সিঁদুর দিয়ে…পুরুত মন্তর পড়েছে, অনেক লোকজন দেখেছে। এ বিয়ে অস্বীকার করব কী করে।’
মুখে হাত চাপা উমা থরথর কেঁপে উঠল, এবার চোখ দিয়ে জল নামবে। রতন ভয় পেল, মা অজ্ঞান হয়ে না যায়!
‘এ তুই কী করলি রতু? তুই যে এই বংশের একমাত্র ছেলে! বংশটা নষ্ট হয়ে গেল। …কী বলে তুই অন্য জাতের অমন অসভ্য ইতর একটা মেয়েকে…ছি ছি ছি মুখে কী নোংরা অসভ্যের মতো কথাবার্তা…পারলি কী করে বিয়ে করতে?…রতু তোর মতো এত ভদ্র ভালো ছেলে, সবাই কত প্রশংসা করে, তুই আমাদের সবার মুখে চুনকালি দিলি! কী অপরাধ করেছি তোর কাছে?’ উমার স্বর কাতর থেকে আরও কাতর হয়ে কান্নায় মিশে গেল।
মাথাটা মায়ের পায়ে ঠেকিয়ে রতন কপালটা ঘষতে শুরু করল।
‘আমাকে আর ছুঁসনি তুই।’ উমা দু-পা পিছিয়ে গেল। ‘তোর মুখ দেখতে ঘেন্না হচ্ছে।’
‘দেখতে হবে না, এ মুখ সত্যিই আমি দেখাতে পারব না। …আমি চলে যাব। এ সংসারে থেকে তোমাদের লজ্জা দোব না।’
‘তোর কাকা শুনলে আত্মহত্যা করবে…আমারই গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করছে। …রতু এ তুই কী করলি রে!’
‘কাকাকে কিছু বোলো না, অন্তত যতদিন আমি এ বাড়িতে আছি। …তোমার আশীর্বাদ চাই না মা, আমাকে যত পারো অভিশাপ দাও।’ বাচ্চচা ছেলের মতো রতন হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। …’চলে যাব আমি…কর্মফল আমি একাই ভোগ করব। কপালে যা আছে তাই হবে।’ রতন জানালায় গিয়ে গরাদ ধরে দাঁড়াল। লন্ড্রিতে কাচানো জামাকাপড় নিয়ে বিষ্ণু ফিরছে। সে একবার জানলায় দাঁড়ানো রতনের দিকে শুধু তাকাল। সামনের বাড়ির ছোটুদা দরজার কড়া নেড়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। রতনকে দেখে বলল, ‘ভালো?’ অস্ফুটে সে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’
আট
গ্রে স্ট্রিট আর নব মিত্র লেনের মোড়ে শিবি দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা থেকে। এইখান দিয়ে রতন বাড়ি ফিরবে অনুমান করে সে অপেক্ষা করছে। রতনকে আসতে দেখে সে এগিয়ে গেল। রতন তাকে দূর থেকেই দেখতে পেয়েছে। বুকটা একবার ছ্যাঁত করে উঠল। শিবি তাকে ছাড়বে না। স্ত্রীর অধিকার যদি চেয়ে বসে। যদি বলে শ্বশুরঘর করব?
‘এখানে দাঁড়িয়ে যে, আমার জন্য?’ চাপা গলায় বলল রতন। ফুটপাথ দিয়ে লোক চলাচল করছে প্রায় গা ঘেঁষে। তার মধ্যে পাড়ার লোকও থাকতে পারে, দেখলে কী ভাববে! তাদের মধ্যে কী ধরনের কথাবার্তা হবে, তা সে আন্দাজ করতে পারছে। দাঁড়িয়ে না থেকে রতন মন্থরভাবে হাঁটতে শুরু করল, তার পাশাপাশি শিবিও। ওর সিঁথিতে ক্ষীণ সিঁদুরের রেখা সে দেখে নিয়েছে।
‘বলো, কী বলবে?’ রতনের উদাস কণ্ঠে অনিচ্ছার আভাস।
‘মা বলেছে আর থাকতে দেবে না, কী করব?’
‘বিয়ে করার আগে সেটা ভেবে দেখোনি কেন? কীভাবে কাল বিয়ে বিয়ে খেলাটা হল! এটা কি বিয়ে?’
‘বিয়ে নয়?’ শিবির স্বরে বিমূঢ়তা! অবাক চোখে সে রতনের মুখ দেখার চেষ্টা করল। ‘শালগ্রাম ছিল, পুরুতমশাই মন্তর পড়ল, অগ্নিসাক্ষী রেখে মালাবদল হল, সিঁদুর পরিয়ে দিলে তুমি নিজের হাতে, আর বলছ বিয়ে নয়! বস্তির কত বউ-মেয়েরা দাঁড়িয়ে দেখল পর্যন্ত, আর বলছ এটা কি বিয়ে?’ শিবির গলা চড়ে উঠল।
রতন বিব্রত হয়ে দু-পাশে তাকাল। কেউ যদি শুনে থাকে তা হলে একবার তাদের দিকে তাকাবেই। কেউ তাকায়নি। তবে এমন উঁচু গলায় শিবি যদি আবার কথা চালায় তা হলে তাকাবেই। রতন দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘এখন আমি কী করতে পারি?’