এই ৫৬/৫৭ সালে আমার জীবনের আরও একটি বড়ো ঘটনা ঘটে গেছে। বাংলা সাহিত্যের মোড় বদলটাও এই সময় থেকে শুরু। এর আগের লেখক বিমল কর, সমরেশ বসু, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, রমাপদ চৌধুরি প্রমুখের একটি আলাদা ধরন ছিল। কিন্তু তাঁদের সময়ে কী বিষয়ে, কী আঙ্গিকে আন্তর্জাতিকতা আসেনি। আমাদের সময় থেকে লেখকেরা আন্তর্জাতিকতার দ্বারা প্রভাবিত হতেন। ডস্টয়েভস্কি, কাফকা, টমাসমান এলেন। সেই সময়ে সার্ত্র এবং কামুও এসে গেছেন। এঁদের লেখালেখি তখন পড়তে শুরু করেছি। হাওয়ার্ড ফাস্ট, স্টেইনবেক, কডওয়েল আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে স্টেইনবেক। এঁদের লেখালেখি পড়তে পড়তে লেখা সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে সমাজ সম্পর্কে আমার ধারণা বদলাচ্ছে। গড়ে উঠছে নতুন নতুন ধারণা। গল্পে নতুন ধারা এল। গল্প বলায় বিদেশি প্রভাবে আঙ্গিক সচেতনতা এল।
এইরকম একটা সময়ে ১৯৫৬-য় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যান। তাঁর শোকসভায় যেতে গিয়ে আমি প্রথম কফি হাউসে যাই। অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য সজনীকান্ত দাস চাঁদা সংগ্রহ করেছিলেন। শোকসভাটি হয়েছিল ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে।
সেই অনুষ্ঠানে ‘উল্টোরথ’ পত্রিকার তরফ থেকে ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি উপন্যাস’ প্রতিযোগিতার কথা ঘোষণা করা হয়। তখন উপন্যাসের প্রকাশক হিসাবে উল্টোরথের কোনো তুলনা নেই। ওখানে সব বড়ো বড়ো লেখকই তখন লেখেন। একেবারে ডাকসাইটে পত্রিকা। তো, এই অনুষ্ঠান থেকে ঘোষণাটি কানে নিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম। তারপর প্রায় একশো পৃষ্ঠার একটা উপন্যাস লিখে নিয়ে জমা দিতে গেলাম। গিয়ে দেখলাম সবাই অনেক যত্ন করে ভালো দামি কাগজে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে জমা দিয়েছে লেখা। আমার অযত্নের পাণ্ডুলিপি, ময়লা কাগজ। উদ্যোক্তারা বললেন, এইভাবে কেউ পাণ্ডুলিপি জমা দেয়? কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁরা উপন্যাসটি জমা নিলেন এবং আমাকে রসিদ দিলেন। এই উপন্যাস প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক ও নগদ পাঁচশো টাকা পুরস্কার পাই। মনে আছে দ্বিতীয় হয়েছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। আর তৃতীয় স্থান লাভ করেছিলেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। রংমহলে একটা অনুষ্ঠান করে আমাদের পুরস্কৃত করা হয়। উপস্থিত ছিলেন অশোক কুমার সরকার এবং জ্যোতি বসু। ওই রংমহলেই পূর্ণেন্দু এবং অতীনের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ।
পরে শুনেছি এই উপন্যাস প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন বিমল মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও লীলা মজুমদার। সবার উপরে ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। প্রাথমিক বাছাইয়ের পর প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রথম পুরস্কারের জন্য আমার উপন্যাসটাকেই বেছে নিয়েছিলেন। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘ধুলো বালির মাটি’। বিখ্যাত লেখক ননী ভৌমিকের ‘ধুলোমাটি’ উপন্যাসের দ্বারা আমি প্রভাবিত হয়েছিলাম। নামকরণের ক্ষেত্রে।
তখন আমি পরিচয় পত্রিকায় গল্প দেখার দায়িত্ব পেয়েছি। মস্কো থেকে ফিরে এসে ননী ভৌমিক একদিন আমার উপন্যাসটা পড়তে চান। পরে একটা জায়গা দেখিয়ে বলেন, এই জায়গাটা বেশ কাঁচা হয়ে গেছে। আমি বাড়ি ফিরে এসে ওই জায়গাটা ছিঁড়ে ফেলে সংশোধন করি। ননীবাবুর কাছে আমি ঋণী। ননী ভৌমিক, সমরেশ বসু একই সময় সাহিত্যের জগতে এসেছিলেন। ওঁরা শিক্ষিত গদ্য লিখতেন।
আমার প্রথম লেখা অবশ্যই একটা গল্প। ছাপার হরফে বেরোয়নি। আমাদের পাড়ায় একটি লাইব্রেরি ছিল। পূর্বাচল। ৫০ সাল নাগাদ ওই লাইব্রেরির দেওয়াল পত্রিকায় গল্প লিখে আমার লেখক জীবনের শুরু হয়। এই দেওয়াল পত্রিকায় পরে আরও অনেক লিখেছি। তখন আমাদের মধ্যে সোভিয়েত লিটারেচার পড়ার খুব চল ছিল। ক্রস রোড নামে কমিউনিস্টদের একটি পত্রিকা ছিল। সেই ইংরেজি পত্রিকা থেকে, সোভিয়েত লিটারেচার থেকে গল্প অনুবাদ করে দেওয়াল পত্রিকায় দিতাম। হাওয়ার্ড ফার্স্ট, স্টেইনবেক প্রমুখ লেখকেরা এই সময় থেকে আমার ওপরে প্রভাব ফেলতে থাকেন। হেমিংওয়ের ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি, কামুর দ্য ফল, পরে আউডসাইডার, সার্ত্র-এর ইনটিমেসি- এসব রচনা, এইসব বিদেশি সাহিত্য আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু আজও আমরা রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে পারিনি। নকশালরা ভাঙবার কথা বলত। ভাঙত; আমার খুব ভালো লাগত।
বাংলা সাহিত্যে সুবোধ ঘোষ একজন অসাধারণ গল্পকার। দীপেন্দ্রনাথ, সমরেশ বসু, দেবেশ রায় প্রমুখের জাতই আলাদা। অমিয়ভূষণ সৎ লেখক। আর সতীনাথ ভাদুড়ী অতি উচ্চচস্তরের লেখক। আমরা গলি রাস্তা কিংবা রাজ্য নিয়ে আছি। কিন্তু আস্ত ভারতবর্ষ উঠে আসে সতীনাথের লেখায়। ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ পড়তে পড়তে মনে হয় সতীনাথ পূর্ণিয়া শহরের লোক হয়ে, প্যারিস ঘুরে আসা মানুষ হয়ে এঁদের জীবন জানলেন কী করে। বিভূতিভূষণও অত জানতেন না। বাংলা সাহিত্যের আর একজন বড়ো লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র গল্পকার হিসাবে আজও বাংলা সাহিত্যের চুড়োয় বসে আছেন। আমার মনে হয় এই সব চুড়োয় বসে থাকা লেখকদের পুনর্মল্যায়নের সময় এসে গেছে। তুলনামূলকভাবে কলকাতার বাইরে থাকা লেখকেরা অনেক ভালো লিখেছেন বলে আমার মনে হয়। কলকাতায় থাকলে এঁরা হয়তো নষ্ট হয়ে যেতেন।