খেলা আর মাঠ আমার কাছে জ্ঞান হওয়া থেকেই একটা ব্যাপার। এটাই অবশেষে আমার জীবিকা হয়েছে। খেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায়- মানুষের দেহের গুরুত্ব, দেহ সঞ্চরণের সৌন্দর্য, পরিশ্রম দ্বারা অধীত গুণাবলির প্রকাশ যা কখনো কখনো শিল্প আস্বাদনের স্তরে উত্তীর্ণ হয়, এবং সমাজের নীচুতলার মধ্যবিত্ত মানুষের অস্তিত্বে চেহারাটি কেমন, তা আমাকে দেখিয়ে ও বুঝিয়ে দেয়। সুযোগটি আরও বেশি পেয়েছি আমার চাকুরির জন্য। যে দেশে এখনও কুড়ি কোটিরও বেশি মানুষ অর্ধাহারে ধুঁকছে, শতকরা ৭০ জন লিখতে-পড়তে জানে না, সে দেশের শিল্পীর পক্ষে দেশের এই অবস্থাটা কিছুতেই এড়ানো সম্ভব নয়, অবশ্য যদি যোগাযোগ থাকে। ‘স্ট্রাইকার’ বা ‘কোনি’ এই যোগাযোগেরই একটা দিক। এই দিকে রয়েছে হতাশা, আত্ম-অবমাননা, নেতিমূলক ভবিষ্যৎ। এখানে আঁকড়ে ধরার জন্য একমাত্র অবশিষ্ট রয়েছে স্বপ্ন। তার মারফত কাঙ্ক্ষিত জগতে বিচরণ।
কোনো একটা ব্যাপারে নাড়া খেয়েই বা আগে থেকে সযত্নে প্লট তৈরি করে লিখতে বসা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। যুক্তিবিরোধী, অনুভূতিশীল, মনের নির্জ্ঞান অংশ লেখকের কাজের জন্য নিজেদের ভূমিকা অবশ্যই পালন করবে। কিন্তু লেখকের সজ্ঞান মনও আছে এবং তা নিস্ক্রিয় নয়। যখন সমগ্র ব্যক্তিত্ব নিয়ে একাগ্রভাবে লেখক কাজ করে, তখন তার মনের সজ্ঞান অংশটিই দ্বন্দ্ব সংঘাতের মীমাংসা করে, স্মৃতিগুলিকে সংঘটিত করে এবং একই সময়ে তার দুই দিকে চলার চেষ্টাকে রুখে দেয়।
লেখার এইসব চরিত্ররা যতক্ষণ না জমাট পারম্পর্যময় একটা অবয়ব পাচ্ছে বা কাহিনির উদ্দেশ্য এবং রচনার বুনোট সম্পর্কে কিছুটা ধারণা তৈরি হচ্ছে, ততক্ষণ লেখা শুরু করি না।
কী ঘটবে সেই সম্পর্কে অল্প কিছু ধারণা প্রথমে থাকে। এজন্য ছক বেঁধে নিই না, নোটের সাহায্যও নয়। যখন চরিত্ররা জীবন্ত হয়, কথা বলে, তখন এমন সব ব্যাপারের প্রত্যাশায় থাকি যা চমকে দেবে, বিব্রত করবে। ওরা বহু সময় নিজেরাই ঘটনা তৈরি করে কাহিনির পথ বদল করে দেয়। কিন্তু আলগা রাশ সবসময়ই ধরে রাখি, ফলে গন্তব্যচ্যুত হতে দিই না। ওদের কার্যকলাপে যে সংশোধন মনে মনে করতে হয় তাতে অদ্ভুত মজা আছে। তা না করলে জীবনের আসল চেহারাটা মিথ্যা ভোল ধরে দাঁড়ায়।
ভালো লেখা দুর্ঘটনাক্রমে হয় না। ওটা বারংবার লেখারই ফল। একই গল্প বার বার লেখার বাতিক আমার আছে এবং ছাপাতে দেবার আগে আবার ফিরে লিখি। এ সম্পর্কে একশো বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনাটি যথাসম্ভব অনুসরণের চেষ্টা করি। বঙ্কিমের বারোটি নিবেদনের পঞ্চমটি হল : ‘যাহা লিখবেন তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না। কিছুকাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছুকাল পরে উহা সংশোধন করিবেন। তাহা হইলে দেখিবেন প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য, নাটক, উপন্যাস দুই এক বৎসর ফেলিয়া রাখিয়া তারপর সংশোধন করিলে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। যাহারা সাময়িক সাহিত্যের কার্যে ব্রতী, তাহাদের পক্ষে এই নিয়মরক্ষাটি ঘটিয়া উঠে না। এ জন্য সাময়িক সাহিত্য, লেখকের পক্ষে ক্ষতিকর।’
বাংলা ভাষায় যেসব রচনা গল্প-উপন্যাস নামে গত দুই দশক ধরে ‘বিশেষ সংখ্যা’গুলি উদগিরণ করেছে সেগুলির অধিকাংশেরই পাঠযোগ্যতা থেকে চ্যুত হওয়ার কারণ বঙ্কিমই বলে দিয়ে গেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হবে প্রকাশকবৃন্দের তাৎক্ষণিক লাভের কড়ি সংগ্রহের ইচ্ছা। বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগে পুজোসংখ্যাগুলিতে একটিমাত্র উপন্যাসই প্রকাশিত হত। লেখকরা যত্ন নিয়ে লিখতেন। পাঠকরা যত্ন নিয়ে পড়তেন।
নিজের সম্পর্কে এইটুকু বলতে পারি, অযত্নের লেখা কখনো ছাপাতে দিইনি। শুরুতে বছর চারেক শুধু অনুশীলনই করেছি গল্প লেখার। পাইকপাড়ায় শিবশম্ভু পালের বাড়িতে প্রতি রবিবার আমি আর মোহিত চট্টোপাধ্যায় হাজির হতাম। ওরা পড়ত কবিতা, আমি গল্প। চার বছর প্রতি সপ্তাহে একটি করে গল্প লিখে গেছি। পরে ওগুলো ফেলে দিতাম। একদিন ওরা বললে, এটা ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঠানো যাক। আমরা নোংরা পাণ্ডুলিপি এবং হাতের লেখা দেখামাত্রই সম্পাদক যে গল্পটি অবিলম্বে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেবে এ বিষয়ে ওরা নিঃসন্দিগ্ধ, তাই শিবশম্ভু কপি করে দেয় ওর মুক্তার মতো হস্তাক্ষরে। বোধহয় বীরেন্দ্র দত্ত গল্পটি ‘দেশ’ অফিসে দিয়ে আসে। মাস ছয়েক পর ১৯৫৭২-র মার্চের সকালে পাইকপাড়া থেকে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে শিবু আমাকে ঘুম থেকে তুলে আনন্দবাজার দেখাল। আগামী সংখ্যায় শ্রী মতি নন্দীর লেখা ‘ছাদ’ গল্পটি বেরোবে। কুড়ি টাকা পেয়েছিলাম।
‘ছাদ’-এরপর পরিচয় পত্রিকায় পাঠাই ‘চোরা ঢেউ’ গল্পটি। মাসখানেক বাদে এক দুপুরে যাই, মনোনীত হবে কিনা জানতে। কোনো পত্রিকা দপ্তরে এই আমার প্রথম যাওয়া। মিষ্টি হেসে মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর হাতের প্রুফটা এগিয়ে ধরলেন। সেটি ‘চোরা ঢেউ’-এর। কয়েক মাস পর তাঁর চিঠি পেলাম, পুজো সংখ্যার জন্য গল্প চেয়ে। গল্প চাওয়া প্রথম চিঠি আমার জীবনে। চিঠিটি আমার কাছে স্যুভেনির হয়ে আছে। লিখেছিলাম ‘বেহুলার ভেলা’। নামটা বিষ্ণু দের কবিতা থেকে নিয়েছিলাম। কবিতাটার নাম ছিল ‘পঁচিশে বৈশাখ’৩। লেখক হিসাবে সেই আমার যাত্রা শুরু।