একটু দূরেই কী একটা নিয়ে তর্কাতর্কি হচ্ছে। হঠাৎ জোর গলায় এক ছোকরা বলে উঠল, সুইমিং কস্টুম পরেছিল তো কী হয়েছে? দেখুন গিয়ে কলকাতার হাজার হাজার বাড়িতে মেয়েরা সায়া-ব্লাউজ পরে না, বুক খুলে গঙ্গায় চান করে।’
‘শুধু বুড়িরাই করে।’
‘বেশ তাই-ই করে। সেটা কি দেখতে খারাপ লাগে না? বুড়ি বলে নয় ধরা গেল তার সেক্স নেই কিন্তু কথাটা হচ্ছে ভালো লাগা বা কুচ্ছিত লাগা নিয়ে রুচি, নিয়ে, তাই তো?’
‘অতশত বুঝি না বাপু, তবে ইন্ডিয়ানদের চোখে এসব ভালো লাগে না। এসব বিলেতের মেয়েরা করলে কিছু বলার নেই। পাত্রপক্ষ যদি তোমার বোনকে দেখতে এসে বলে নেংটি পরো, সৌন্দর্য আছে কিনা দেখব, তখন তুমি কি বোনকে কস্টুম পরাবে?’
‘পার্সোনাল টাচ দিয়ে কথা বলবেন না বোসদা, যা নিয়ে কথা হচ্ছে তাই নিয়ে বলুন।’
‘কেন বলব না? নিশ্চয় বলব, একশোবার বলব। ইন্ডিয়ান মেয়ে মাত্রেই তোমার বোন। রিতা ফারিয়াও তোমার বোন। সে পরলে যদি আপত্তি না করো তাহলে নিজের বোনের বেলাতেও আপত্তি করবে না, বলো করবে?’
বোসদা নামক টাক মাথার লোকটি চেয়ার ছেড়ে টেবলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। পাশের লোকেরা মিটমিট করে হাসছে। তারক দেখল ছোকরার মুখ লাল, নিরুপায়ের মতো এধার-ওধার তাকাচ্ছে।
‘না করব না।’ টেবলে চাপড় মেরে চোকরা চিৎকার করে উঠল, ‘করব না।’
অনেকগুলো চিৎকার ফেটে পড়ল একসঙ্গে। ছোকরা উঠে চলে গেল। পদ্মনাথবাবু চাপা স্বরে বলল, ‘কীরকম বুঝছেন দিনকাল?’
তারক হেসে চুপ রইল।
‘আমাদের জীবদ্দশায় মেয়ে দেখার এই সিস্টেমটা যদি চালু হয় তাহলে আবার বিয়েই বসে যাব মশাই।’
হ্যা হ্যা করে হাসতে থাকল পদ্মনাথবাবু। তারক পায়োরিয়ার গন্ধে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই দেখল হিরণ্ময় ঢুকছে, সঙ্গে ব্রাঞ্চ সেকশনের বিমল মান্না। হিরণ্ময় ঘাড় নেড়ে মান্নার কথা অনুমোদন করতে করতে তাকিয়ে দেখে নিল ঘরের লোকেদের। তারককে দেখে এগিয়ে এসে সামনের চেয়ারে বসল।
‘কাল ময়দানে রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির সভায় যাচ্ছেন তো?’
তারকের মনে হল, যেন হালকা বিদ্রুপ রয়েছে সুরে।
‘তাই নাকি।’ বলেই সে ভাবল, এতে হিরণ্ময় কি বুঝতে পারবে ওকে তোয়াক্কা করি না।
‘কাল আমরা ছুটির পর গেটের সামনে জমায়েত হচ্ছি। যদি পারেন তো আসুন। পদ্মবাবু সার্কুলারগুলো আজই কিন্তু আপনার ডিপার্টমেন্টে বিলি করে দেবেন, অন্তত তিনশো লোকের মিছিল এবার করতেই হবে।’
পদ্মনাথবাবু ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ল, যেন এখুনি বিলি করতে যাচ্ছে। একা মুখোমুখি হিরণ্ময়ের সঙ্গে বসে থাকতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করল তারক। বয়সে অন্তত সাত-আট বছরের ছোটো কিন্তু চালটা এমন ভারিক্কি আর ব্যস্ত, তারকের অস্বস্তি হয় ওকে দেখলেই। ওর কথাবার্তার মধ্যে এমন বহু শব্দ থাকে, মনে হয় শ্লোগান থেকে খুঁটে নেওয়া, বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন, অভ্যেসে বলে যায়। বক্তৃতার সুর ওর কথাতেও এসে গেছে। ফলে মনে হয়, উপদেশ আর নির্দেশ দিচ্ছে। দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ফলে জানুয়ারি থেকে মাইনে বেড়েছে, হিরণ্ময়কে দেখে মনে হয় যেন একমাত্র ওর জন্যই সম্ভব হল। জি এম পর্যন্ত ওকে খাতির করে। ক্ষমতাও আছে, নয়তো মিথ্যে মেডিকেল বিল দেওয়ার ব্যাপারে বিমল মান্নার তো চাকরি যাওয়ারই কথা।
‘আচ্ছা তারকবাবু’ বোসদাকে ঘিরে বসা জটলা থেকে একটি ছেলে উঠে এল। ‘গ্যারি সোবার্সের মতো অল রাউন্ডার কখনো জন্মেছে কোনকালে?’
তারক ছেলেটির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘হঠাৎ আমাকে এ প্রশ্ন কেন?’
ছেলেটি অপ্রতিভ হয়ে গেল। ‘আপনিতো খেলতেন টেলতেন, বেঙ্গল টিমেও এসেছিলেন, আপনার মতামতের মূল্য নিশ্চয় আছে। আমাদের থেকে নিশ্চয়ই বেশি বোঝেন। বোসদা বলছে কিথ মিলার নাকি সোবার্সের থেকেও বড়ো! উনি নাকি মিলারের খেলাও দেখেছেন!’
তারকের প্রথমেই মনে হল, ছেলেটি বাজে তর্ক করে সময় কাটাবার জন্য তাকে হাতিয়ার করতে চায়। তার বদলে, মতামতের মূল্য আছে-টাছে বলে খানিকটা দাম আগাম চুকিয়ে দিল। তারপর তারকের মনে হল, হয়তো কাউকে পরে জিজ্ঞাসা করবে, টি সিনহার স্কোর কত ছিল? কোন বছর খেলেছিল?
‘বলতে পারব না, আমি কারোর খেলাই দেখিনি।’
ছেলেটির চোখে অবিশ্বাসের ছায়া পড়ল। ‘সেকি, হতেই পারে না।’
‘বললুম তো।’ তারকের গলা কঠিন শোনাল।
‘আপনি সোবার্সের খেলাও দেখেননি!’
জবাব না দিয়ে তারক মুখ ফিরিয়ে রইল। ছেলেটি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। তারক লক্ষ করল হিরণ্ময়ের চোখে কৌতূহল, কিছু একটা বলবে।
‘আপনি এখন আর খেলেন না?’ হিরণ্ময় দেশলাই কাঠি বার করল কান চুলকোবার জন্য। তারক প্রথমে ভাবল, জবাব দেবে না। তাই না শোনার ভান করে রইল।
‘আপনি কতদিন খেলা ছেড়ে দিয়েছেন?’
তারক এবার তাকাতে বাধ্য হল। হঠাৎ তাঁর মনে হল নারানের ইন্টারভিউ পাওয়ার ব্যবস্থা তো একে দিয়েই করানো যায়। ইনক্রিমেন্ট বন্ধের শাস্তিও যখন মকুব করিয়ে দিতে পারে।
‘দশ-বারো বছর মাঠে যাই না।’
তারক সতর্ক হয়ে বলল যেন বেশি দূরে কথা না গড়ায়। অবশ্য খেলার দিকে হিরণ্ময়ের ঝোঁক আছে বলে মনে হয় না। নারানের জন্য কিছু একটা উপায় করতে হবে ওকে দিয়ে।
‘যান না কেন?’
‘ভালো লাগে না।’