‘মিস্টার তেওয়ারি ডাকছেন। তুমি বরং চালিয়ে নাও আজকের দিনটা, আমি ওকে বলছি লোক দেবার জন্য।’
ইন্দ্র ভটচায উঠতে উঠতে বলল। তারক নিজের চেয়ারে ফিরে এল। গুহ সম্পর্কে তার রাগ এখন অনেক কম। দাদটা ছোঁয়াচে তো বটেই, যদি গুহর হয়? এই কথা ভাবতেই গুহর আঙুলগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। কিন্তু ওখানেই যে হবে তার কোনো মানে নেই। ঘাড়ও হতে পারে, যত লোকের দেখা যায় সবই তো ঘাড়ে। ফর্সা সলিল গুহর দাদ হলে খুবই ক্যাটক্যাট করবে। মুখচোরা ভালোমানুষ ধরনের বটে, কিন্তু সাজগোজ চেহারার দিকে খুব যত্ন। মার্জিত গোটা গোটা উচ্চচারণে কথা বলে-অরুনধুতি না বলে অরুন্ধতীই বলে। দাদ হলে নিশ্চয় ঘাড়ে মাফলার জড়িয়ে ঠান্ডা লাগার ভান করবে।
গুহর দাদ হলে দায়ী হব আমি, তারক যখন এইসব ভাবতে ভাবতে কাজ শুরুর উদ্যোগ করছে, রতন দত্ত এসে ফিসফিস করে বলল, ‘ইঁদুরটার সঙ্গে কী কথা হচ্ছিল?’
‘কী আবার কথা হবে।’
‘আহা বলোই না, তুমি তো খুব ডেঁটে বলছিলে মনে হল। ওভার টাইম?’
ডেঁটে কথাটা শুনে তারক খানিকটা মজে গেল। বলল, ‘ওভার টাইম তো এই রোববারই করলেন, আবার চাই?’ তারক গলাটা সুপরিনটেনডেন্টের মতো করার চেষ্টা করল। ‘আপনার বিলটা তেওয়ারি সাহেব চেয়েছেন।’
রতন দত্ত পাংশু হয়ে গেল।
‘কেন কেন, ভুল হয়েছে কিছু?’
‘ফোনে ইন্দ্রদাকে বলছিল শুনলুম। কেন চাইল শুনতে পেলুম না। এমনিতেই ফাঁকি দেন, ওভার টাইমেও দু-ঘণ্টার কাজ ছ-ঘণ্টায় করেন বোধ হয় তাই নিয়েই হবে।’
তারক প্রায়ই মজা করার জন্য রতন দত্তকে ভয় দেখায়। সেটা যখন বোঝে রেগে ওঠে।
‘ফাঁকি আমি একাই দি? তুমি কি দাও না?’
‘কবে দিয়েছি বলুন।’
‘কবে আবার কী, রোজই দাও। যারা ফাঁকি দেয়, তেল দেয় তাদেরই উন্নতি হয়।’
‘আমার কি উন্নতি হয়েছে?’
‘তোমার হয়নি’ রতন দত্ত থতোমতো হল, কিন্তু দমল না। ‘অন্যদের তো হয়েছে। জানো, ইঁদুরটা আমার চার বছরের জুনিয়ার? আমি তো বউকে জি এম-এর বেডরুমে পাঠাতে পারিনি তাই কেরানি হয়েই রইলুম আর ও অফিসার গ্রেডে উঠে গেল। সুপারিসড করে প্রমোশন! কই ইউনিয়নের বাবুরা এই নিয়ে তো লড়ল না।
পিছনের টেবল থেকে গোরা মিত্তির বলল, ‘আপনি তো ননম্যাট্রিক, ইন্দ্র ভটচায বি কম। ইউনিয়ন লড়বে কোনো গ্রাউন্ডে বলুন। শুধু সিনিয়ারিটিতেই তো হয় না, কোয়ালিফিকেশন বলেও একটা ব্যাপার আছে।’
‘হ্যাঁগো হ্যাঁ জানা আছে, কত তো কোয়ালিফিকেশনওলা সব। আমার বেলাতেই যত আইন আর রুলস। তারকই বলুক, ফলস মেডিকেল বিল দিয়ে যারা ধরা পড়ল, তিন বছরের ইনক্রিমেন্ট বন্ধ হল ইউনিয়ন তাদের হয়ে লড়েনি? তারা ইউনিয়নের লিডার তাই এর বেলায় দরদ উথলে উঠল। বল না তারক, চুপ করে আছো কেন।’
রতন দত্ত সপ্তাহে অন্তত একবার এইভাবে সকলকে শুনিয়ে গালিগালাজ করবে। কেউ বিশেষ কান দেয় না যদি না রসালো কেচ্ছার গন্ধ থাকে। তারকের মায়া হয় এই লোকটিকে পাগলের মতো আচরণ করতে দেখলে। শুনেছে ওর স্ত্রীর মাথা খারাপ। বছর পনেরো আগে বড়োছেলেটি পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। মেজোছেলে স্কুল ফাইনাল পাশ করে জার্মানি গিয়ে আর ফেরেনি।
‘রতনদা এবার চুপ করুন।’ তারক অনুরোধ করল।
‘হ্যাঁ চুপই করব, কী হবে এসব কথা বলে, আমার তো রিটায়ার করার সময় এসে গেল।’
রতন দত্ত নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। তারক টানা তিনঘণ্টা কাজ করে, চোখ টনটন শুরু হতেই টিফিন করার জন্য দোতলার ক্যান্টিনে নেমে এল।
ঘরটা লম্বা, দু-পাশে টানা বেঞ্চের মতো টেবল আর স্টিলের চেয়ার, প্রায় ষাটজন বসতে পারে। ঘরটা অর্ধেক ভরা। দরজার পাশেই কুপন কাউন্টার, মেঝেয় দাঁড় করানো একটা ব্ল্যাকবোর্ড। খড়ি দিয়ে খাবারের নাম ও দাম লেখা। তারক পড়তে শুরু করেছে, ক্যান্টিন ম্যানেজার পা নাচাতে নাচাতে বলল, ‘আজ মাংস হয়েছে খেয়ে দেখুন, ছ-আনা প্লেট।’
‘শুধু তো হাড় আর চামড়া।’
‘কী যে বলেন, তিন পিস মাংস, দুটো আলুর টুকরো। কে পারবে দিতে! আলু এক টাকা, মাংস ছ-টাকা কিলো। বাড়িতেও এর থেকে বেশি পাবেন না।’ বলার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা কুপন ছিঁড়ে তারকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রুটি নেবেন তো?’
যেন ধরেই নিয়েছে এরপর আর কোনো বিচার-বিবেচনা চলতে পারে না। তারক তাকে অগ্রাহ্য করবে না।
‘না, মাংস খাব না, শুধু চা আর টোস্ট।’
‘সেকি খাবেন না!’ আহত ভঙ্গিতে ম্যানেজার তারকের দিকে তাকিয়ে থাকল, ‘আমি যে কুপন কেটে ফেললুম!’
‘আর কাউকে বিক্রি করে দেবেন।’ তারক যতটা পারা যায় অগ্রাহ্য করতে চেষ্টা করল অন্যদিকে তাকিয়ে পকেট থেকে পয়সা বার করতে করতে। হ্যাঁ বা না-র তোয়াক্কা না করে কেন কুপন কাটল। আমায় ভেবেছ কী! ওর ইচ্ছে অনুযায়ী খেতে হবে নাকি! তোয়াক্কা শব্দটা তারকের মাথায় কয়েকবার ছোটাছুটি করে গেল।
খাবারের কাউন্টার থেকে চায়ের কাপ আর টোস্ট হাতে তারক ঘুরে দাঁড়াতেই পদ্মনাথবাবু চেঁচিয়ে ডাকল, ‘এই যে আসুন এখানে।’
বসামাত্র তারককে জিজ্ঞাসা করল, ‘পনেরো তারিখের মধ্যে পাচ্ছি তো?’
হয়তো দেরি হবে একটু।’
‘না দাদা, দেরিটেরি বললে শুনব না। তাহলে লাইফ ইনসিয়োর করে ওইদিন আসবেন।’
তারক মুচকি হেসে উপভোগ করল পদ্মনাথের উৎকণ্ঠা। লোকটার কত মাইনে সে জানে। থোক একশো দশ টাকার মতো পাবে, তার জন্য রোজ একবার করে খোঁজ নেবেই। অথচ লিফটম্যানটার পাওনা হয়েছে প্রায় সাড়ে চারশো টাকা। সেদিন একথা জানাতেই মাথা চাপড়ে বলেছিল, ‘চলুন মশাই গিয়ে ম্যানেজমেন্টকে বলি, আমাদের দপ্তরি, পিয়োন করে দিন। আমাদের বাড়বে মাসে দশবারো টাকা আর ওদের পঞ্চাশ টাকা!’