এখন ডন ব্র্যাডম্যান যদি এখান দিয়ে হেঁটে যায়, তারক ভাবল, তাহলে কী হবে? ব্র্যাডম্যান যদি শ্লোগান দেয় ‘কন্ডাক্ট রুল বাতিল করো।’ কত লোক সাড়া দেবে? তারক মনে মনে হাসতে শুরু করল। ‘মূল্যবৃদ্ধি রোধ কর।’ কে করবে, গভরমেন্ট! তারকের হাসি বেড়েই চলল। ব্র্যাডম্যান যদি শ্লোগান দেয় তাহলে সে মিছিলে কত লোক শামিল হবে আর হিরণ্ময় দিলে কত লোক হবে?
‘১৩ই সেপ্টেম্বরের পাওনা ছুটি’ তারপরই ‘তিসরি কসমের’ পোস্টারে ওয়াহিদা রেহমানের বগল। বগলের নীচে কী আছে?-রোধ কর, বাতিল কর, দিতে হবে, চালু কর, চলবে না, করতে হবে? প্রত্যেকটা কথা বগলের নীচে বসিয়ে বসিয়ে মনে মনে গোটা শ্লোগানটা বার বার আউড়ে পরখ করে শুনতে শুনতে তারক অফিসে পৌঁছে গেল।
লিফটে বারোজন নেওয়া হয়। তারক লাইনে দাঁড়িয়ে এগোতে এগোতে পৌঁছে দেখল লিফটের দরজাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারপরই হঠাৎ খুলে যেতে থাকল। লিফটম্যান এক গাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে!
‘চলে আসুন।’
লিফটের মধ্যে পা দেওয়া মাত্র তারক নিজেকে অন্যরকম বোধ করল। দরজাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাইরে লাইনে দাঁড়ানো লোকগুলোর ব্যস্ত মুখ, ফ্যালফ্যালে চাউনি আড়াল পড়ে গেল। ঠাসাঠাসি হয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে তারকের মনে হচ্ছে, লিফটম্যান নিয়ম ভঙ্গ করল তারই জন্য, এই বারোটা লোকের কারোর জন্য নয়। ভেবে সে পরম তৃপ্তি বোধ করল।
লিফটের উপরে ওঠা টের পাওয়া যায় না। শুধু শরীরটা শির শির করে, হালকা লাগে। লিফটের দরজার উপরে চৌকো আটটা সংখ্যার ঘর। সবাই সেইদিকে তাকিয়ে। এক এক তলায় এলেই সংখ্যার আলো জ্বলে উঠছে। কয়েকজন ঘরে বেরিয়ে যাচ্ছে! এই ওঠার সময় তারক বদলে যেতে থাকে। আস্তে আস্তে ভুলে যায় সে বঙ্কুবিহারী সিংহের পুত্র, রেণুকার স্বামী, দুই ছেলের বাবা, কোনোক্রমে আই এ পাশ এক নগণ্য কেরানি, একবার বাংলা রঞ্জি ট্রফি দলে দ্বাদশ ব্যক্তি হয়েছিল। শরীরের শিরশিরানিটা পাবার জন্য গত পাঁচ বছরে সে একদিনও অফিস কামাই করেনি। হরতালেও এসে বিদ্রূপ শুনেছে। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের টান ছাড়িয়ে ওঠার কয়েক সেকেন্ডের আনন্দ তাকে নেশার মতো পেয়ে বসেছে। পৃথিবীর লোকগুলোকে এই সময়টুকুর জন্য তার কাছে অকিঞ্চিৎকর লাগে। চোখ বুজে সে গোনে- দোতলা, তিনতলা এবার চারতলায় থামবে। তার মনে হয়, এখন ডালহৌসি পাড়ার রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে লোকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলবে-ওই যে তারক সিনহা বিরাট ক্রিকেটার, কতবার ভারতকে নিশ্চিত ইনিংস ডিফিট থেকে বাঁচিয়েছে। হিরণ্ময় নিশ্চয় বলবে, আপনি শ্লোগান দিলে সারা দেশ গলা মেলাবে।
‘থার্ড ফ্লোর।’
লিফটম্যান তারককে উদ্দেশ করেই বলল। এই তলায় কেউ নামার নেই। কিন্তু ও জানে তারক স্টাফ সেকশানের লোক, তাই লিফট থামিয়েছে। অপ্রস্তুত হয়ে তারক বেরিয়ে এসেই ভাবল, লিফটম্যানের ছুটির দরখাস্ত বা মেডিকেল বিলের টাকা কি পড়ে আছে? থাকলে নিশ্চয়ই আজ আসবে তদবির করতে। এই ভেবেই তারক আবার তৃপ্ত হল, এবং তখন সে নিজেকে বলল,-রোগটা জানা হয়েই গেছে যখন, ইঞ্জেকসান নিয়ে সারিয়ে ফেলব।
অ্যাসিসটেন্ট সুপারিনটেনডেন্ট ইন্দ্র ভট্টাচার্য-অনেকের ইন্দ্রদা কিন্তু তারক বলে বড়োবাবু-চিন্তিত হয়ে বলল, ‘এগারোটা তো বেজে গেল, সলিল গুহ তাহলে আর আসছে না। বরং ওই যে নতুন ছেলেটি জয়েন করেছে-‘
‘না না’, তারক থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘নতুন-ফতুনের কর্ম নয়। এক ঘণ্টার কাজ চার ঘণ্টায় দাঁড়াবে তাহলে। আজকের দিনটা আমিই চালিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু আক্কেল দেখুন সলিলের, জানে একটা দায়িত্বপূর্ণ কাজ হাতে, পনেরো তারিখের মধ্যে কমপ্লিট করতেই হবে। এখন কি কামাই করার সময়?’
‘আমি কী বলব বল, ডি. জি. এমের লোক।’ ইন্দ্র ভটচায হতাশ ভঙ্গিতে তালু উপুড় করল। তারক বিরক্ত হল এই ভঙ্গি দেখে। কিছুই যদি বলতে না পার তবে এই চেয়ারে বসা কেন!
‘ডি. জি. এম-কে গিয়ে বলুন, পনেরো তারিখের মধ্যে এই পাঁচশো লোকের দশ মাসের মাইনের হিসেব এভাবে চললে থার্ড উইকের আগে হতে পারে না। এ কি সোজা ব্যাপার! প্রত্যেকটা লোকের সার্ভিস ফোলডার খুলে তাদের নাম, ডেজিগনেশন, ছুটির জন্য মাইনে কাটা যাওয়ার হিসেব ইনক্রিমেন্ট কষে তারপর দশ মাসের এরিয়ার পেমেন্টের হিসেব বার করা, দু-জনে মিলে দিনে ছ-সাতটার বেশি হয় না। আর পনেরো তারিখের মধ্যে চাই বলে দিলেই হল। ওদের আর কী হুকুম দিয়েই খালাস। লোক বাড়াতে বললে তো বাড়াবে না, এদিকে রাসকেলটা ডুব মেরেছে। আপনি বরং জানিয়ে দিন।’
এই সময় ফোন বেজে উঠতেই ইন্দ্র ভটচায হাত তুলে তারককে চুপ করতে ইশারা করে ফোনে কথা শুরু করল। ওর ভঙ্গি দেখে তারক বুঝল সুপারিনটেনডেন্টের ফোন। এই সময় সে দেখল, রতন দত্ত তাকিয়ে। চোখাচোখি হতেই মুচকি হেসে চোখ টিপল। তারক চোখ সরিয়ে ফোনে অপর দিক থেকে কী কথা বলছে বোঝবার জন্য ইন্দ্র ভটচাযের মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে ঘাড়ের দাদটা দেখতে পেল। সেরে গেছে, কিন্তু বৃত্তাকার কালো দাগটা মিলোয়নি। প্রায়ই ওইখানটায় হাত বুলোতে দেখেছে তারক। ইন্দ্র ভটচাযের কাছ থেকে ফাইল এলে সে প্রথমেই গুহকে বলে খুলে দেখতে। ঘেন্না করে, সেটা কখনো জানায়নি। জানালেই গুহ বুঝে যাবে ব্যাপারটা। ছেলেটা বোকা নয়, ভাববে তারকদাটা স্বার্থপর।