- বইয়ের নামঃ মতি নন্দী উপন্যাস সমগ্র ২য় খণ্ড
- লেখকের নামঃ মতি নন্দী
- প্রকাশনাঃ দীপ প্রকাশন (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০. আমার লেখক হয়ে ওঠার কথা – অভীক চট্টোপাধ্যায়
শিবু, শিবু, বলে ডাক দিয়ে বাস থেকে লাফিয়ে নামলাম। সেটা ১৯৫৩ সাল হবে। শিবু মানে শিবশম্ভু পাল। আমার বন্ধু। সবসময় ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আর কবিতা লেখে। সেদিন শিবুর সঙ্গে আর একজন যুবক ছিলেন। মোহিত চট্টোপাধ্যায়। সেদিন শিবু আমাকে মোহিতের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। মোহিত তখন নাটক নয়, কবিতা লেখে। সে সময়ে লেখালেখি নিয়ে ওদের সঙ্গে কথা হয়।
কথামতো একটা গল্প নিয়ে এক রোববার শিবুর বাড়িতে গেলাম। তখন মার্কসবাদ আমার মধ্যে ভুরভুর করছে। সেদিন শিবুর বাড়িতে প্রধান আলোচক ছিলেন মোহিত। গল্প পড়তে গিয়ে দেখলাম আমার বুক ধুপধুপ করছে। কিন্তু পরে মোহিতের বক্তব্য শুনে খানিকটা উৎসাহও পেলাম। পরের রোববার আবার গল্প লিখে নিয়ে গেলাম। এইভাবে প্রত্যেক রোববার গল্প লিখে নিয়ে যেতে থাকলাম। ওই আড্ডাতে তখন বীরেন্দ্র দত্ত, বিশ্ববন্ধু ভট্টাচার্যরা আসতেন। টালার কাছে শৈলজানন্দের পাশের বাড়িতে থাকতেন বিশ্বজীবন মজুমদার। রবিবার বিকেলে কখনো কখনো ওঁদের বাড়িতেও আমাদের আড্ডা বসত।
যে সময়টার কথা বলছি, ৫৩-৫৪, এ সময়ে আমি ময়দানে খেলে বেড়াতাম। বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে ফ্রেন্ডলি ক্রিকেট ম্যাচ খেলতাম। বাড়িতে গল্প লেখা আর ময়দান চষে বেড়ানো- তখন এই আমার কাজ। বাবা মারা গেছেন আমার মাত্র এক বছর বয়সে। ছাড়া গোরুর মতো ঘুরে বেড়াতাম।
ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে বুঝলাম বয়স বাড়ছে। তখন পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। আমার যা বিদ্যে তাতে কোনো চাকরি হবার নয়। আই এসসি পাশ করার পর অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমা করেছিলাম। পরে ভেবে দেখলাম ওসব আমার পোষাবে না। ফলে আবার পড়ার ঝোঁক চাপল। অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের সুপারিশে মণীন্দ্র কলেজে খেলার কোটায় ভরতি হয়ে গেলাম। বাংলায় অনার্স নিয়ে। সেটা ১৯৫৬ সাল। খেলার কোটায় ভরতি হয়েছিলাম বটে, কিন্তু কলেজে খেলা তো ঘোড়ার ডিম। তেমন খেলতে হত না। দু-একটা ক্রিকেট খেলেছি। চাকরির ব্যাপারটা না থাকলে আমি আর এসব পড়াশোনার মধ্যে যেতাম না।
আমার ছোটোবেলায়, বাইরের ঘরে বাবার ছবির নীচে একটি বাঁধানো সার্টিফিকেট ছিল। তিনি প্রথম মহাযুদ্ধের আই এম এস। আমার এক বছর বয়সে মারা যান। আমার জন্ম ১০ জুলাই ১৯৩১। সেই সার্টিফিকেটের এক কোণে সই ছিল ‘George V’। মা সগর্বে বলতেন, ওটা পঞ্চম জর্জের নিজ হাতের সই। আমার মনে হয়েছিল রাবার স্ট্যাম্প। একদিন কাঁচ খুলে ব্যাপারটা পরীক্ষা করে বুঝলাম ওটা রাবার স্ট্যাম্পই। মা-র জন্য যে করুণাবোধ করেছিলাম, সেটা ক্রমশই সারল্যগ্রস্ত মোহের প্রতি মমতায় পরিবর্তিত হয়।
আর একটা জিনিস বাইরের ঘরে টাঙানো ছিল- মামলার রায়। কাকাদের সঙ্গে ফৌজদারি মামলা হয়। তখন আমি বছর ছয়েকের। বৃদ্ধ কাকা, নাবালক ভাইপোর কাছে আদালতে ক্ষমা চান। ‘বসুমতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত সেই খবরটি কেটে বাঁধিয়ে রাখে আমার এক দাদা। উদ্দেশ্য : কাকার ছেলেরা ওটা দেখে যেন নির্যাতন ভোগ করে। ব্যাপারটাকে ঘৃণা করেছি। পাঠশালায় আমাদের সঙ্গে পড়ত, নাম সম্ভবত নির্মল, স্বাস্থ্যবান গৌরকান্তি সুদর্শন। চাকরের সঙ্গে আসত সোনাগাছি থেকে। দুপুরে চাকর তার জন্য আনত দুটি বৃহদাকার সন্দেশ ও দুধ। অনেকে তার খাওয়া দেখত, তার মধ্যে আমিও ছিলাম এবং ঈর্ষা বোধ করতাম। সোনাগাছিরই এক বারাঙ্গনার ‘আঁটকৌড়ে’ তোলার জন্য পাঠশালা থেকে কয়েকজন ছেলে নিয়ে যাওয়া হয়, আমিও ছিলাম। খই, কড়ি, সুপারি ইত্যাদির সঙ্গে ছিল একটি দু-আনি। আমার প্রথম আয়। দু-আনিটা আমাকে অভিভূত করে রেখেছিল বহুদিন। ওটা আমার মেরুদণ্ডে কাঠিন্য এনে দিত, মাটিতে বেশ শক্তভাবে পা ফেলতাম। পরে ওটা হারিয়ে যায় বা চুরি যায়।
ক্লাস সেভেন থেকেই গড়ের মাঠে যাতায়াত। শৈলেন মান্নার ফ্রি-কিক দেখার লোভ সম্বরণের সাধ্য ছিল না। ডেনিস কম্পটন আর হার্ডস্টাফের ব্যাটিং দেখি সাহেবদের একদিনের একটি ম্যাচে (কোচবিহারের যুবরাজও ছিলেন), ইডেনে গাছতলায় কাত হয়ে শুয়ে। কম্পটনের ফুটবল খেলা তখনকার মোহনবাগান মাঠে গোলের পিছনে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম। ‘ভিক্ট্রিসেলিব্রেশন’ ম্যাচ আই এফ এ-র সঙ্গে, খেলায় টিকিট ছিল না। গলিতে গ্যাসবাতি থেকে ব্ল্যাক আউটের ঠুলি তখনও খোলা হয়নি। বিকেলে সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুয়ে দাঁড়াতাম মিলিটারি দেখার জন্য। একদিন চমকে উঠেছিলাম, হাত দশেক দূরে জওহরলাল নেহরুকে দেখে। একটা ছাদখোলা মোটরের পাদানি থেকে নেমে তাড়াতাড়ি ভিতরে গিয়ে বসলেন। পিছনে ছুটে আসছে কিছু লোক জিন্দাবাদ ধ্বনি দিতে দিতে। জয়পুরিয়া কলেজের উদ্বোধন করতে নেহরু এসেছিলেন। কাছে থেকে সেই প্রথম একজন কান্তিময় পুরুষকে দেখা। বালক রোমাঞ্চ পেয়েছিল। কিন্তু ভালো লাগেনি গান্ধীজিকে। তিনি তখন বেলেঘাটায়। আমরা কংগ্রেস সেবাদলের স্বেচ্ছাসেবক। খাকি হাফপ্যান্ট-শার্ট ও সাদা খদ্দরের টুপি মাথায় ভোরে আমরা লরিতে যেতাম পাহারাদারির, ভিড় নিয়ন্ত্রণের এবং ফরমাস খাটার জন্য। গান্ধীজির গায়ে একবার আঙুল ছোঁয়াবার ইচ্ছা হয়েছিল। সকালে বেড়িয়ে ফিরছেন, ভেবেছিলাম তখনই ছোঁয়াব। পাশে দাঁড়িয়েও সম্ভব হয়নি, হঠাৎ লজ্জায় পেয়ে বসে। ওঁর গায়ের গন্ধ পাচ্ছিলাম, খুব সাধারণ, মনে না-রাখার মতো গন্ধ। মনে নেইও। এখন, প্রায় পঞ্চাশ বছর পর ইচ্ছা করে আবার গন্ধটা পেতে। বেলেঘাটার সময়ই ১৫ আগস্ট। সেই রাতে কলুটোলা দিয়ে লরিতে যেতে যেতে মুখে ফেনা তুলে চিৎকার করেছি ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই; ভুলো মৎ, ভুলো মৎ।’ কচি১ তখন ‘কাঁকর’ হয়ে চেতনায় ঢুকে গেছে। ওটাই ছিল স্কুলে আমার শেষ বছর। পরের বছর ধ্যানচাঁদকে প্রথম ও শেষবারের মতো ক্যালকাটা মাঠে খেলতে দেখি। কৈশোরই আমার মানসিকতার একটা ছাঁচ তৈরি করে দেয়।