-চুপচাপ যে, যা জিগ্যেস করার করো।
বড়বৌ এতক্ষণে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। দুশ্চিন্তা মাধবীর থেকেও তার বেশি। পয়সাওলা ভাজ আর ভাইঝি সহজে তার কাছে আসে না। বাড়ির অনেকেই তার দাদার সংসারের গল্প শুনেছে। সেই সংসারের মানুষজনকে এনে এ বাড়ির সকলকে দেখানর সাধ তার অনেক দিনের। রমার কথা সাত কাহন করে বলে ওদের সে এ বাড়িতে এনেছে। রমাকে ছোট থেকে দেখেছে। মেয়েটা নরম স্বভাবের। লেখাপড়া না শিখলেও গেরস্তালি শিখেছে, উঁচু কথা শেখেনি। যে কোন ঘরে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে। বাপ মায়ের সেই সঙ্গে বড় বৌয়েরও মান রাখতে পারবে। নিশ্চিন্ত ছিল বড়বৌ কিন্তু বুলার মায়ের কথায় বার্তায় এখন দুশ্চিন্তা দেখা দিল। বিয়ের আগে, বাপের বাড়ির সংসারে বড়বৌ যাকে জানত, এখন সে মানুষটার চালচলন কেমন দূরের হয়ে গেছে। তখন দাদা সামান্য কেরানীমাত্র ছিল, তারপর ধাপে ধাপে উন্নতি করেছে। কিন্তু তখন আর বড়বৌ বাপের বাড়িতে নেই। শ্বশুরবাড়ি থেকে সে আঁচও করতে পারেনি যে তার দাদা বড়মানুষ হয়েছে। মাঝে মধ্যে বেড়াতে গেছে, মুগ্ধ হয়ে ফিরে এসেছে, মানুষগুলোর পরিবর্তনটা চোখে পড়েনি। এখন নিজের হাভাতে আওতার মধ্যে বড়বৌয়ের চোখ খুলছে।
-চুল দেখেছ কেমন, বলেছিলুম যা মিলিয়ে দেখ, সত্যি কিনা।
বড়বৌ রমার খোঁপাটা খুলে দিল। পিঠের উপর বেণীটা ঝুলে পড়ল। হাতে নিয়ে পরীক্ষা করল বুলার মা আর ব্যাগটা কাছে টানল বুলা। রমার মনে হ’ল, অমন করে ব্যস্ত হ’য়ে সেও জলের ঘটিটা টানে যখন উনুনে ডাল পোড়ার গন্ধ বেরোয়।
-চুল বুলারও ছিল।
বুলার মার সঙ্গে সঙ্গে সকলের চোখ পড়ল বুলার দিকে।
রমাও মুখ তুলে দেখল। হাসল বুলা। হাসিটা শুকনো।
-কি করবো যা চুল উঠতে শুরু করেছে, মাথায় চিরুণী দিতে ভয় হতো।
বেশ সহজ সুরে হেসেই কথাগুলো বুলা বলল। ওর মা রাগের মাথায় তার উত্তর দিল।
-উঠবে না তো কি! সময়ে খাওয়া নেই, শোওয়া নেই। দিন দিন শরীরের যা হাল হচ্ছে। ডাক্তারবাবুর কথামত গাদাখানেক ওষুধ এসে পড়েই আছে, খাওয়ার সময় আর হয় না।
-শরীর না সারলে কিন্তু বিয়ে হওয়া মুশকিল। বরের পছন্দ হবে না।
বড়বৌয়ের কথায় হাসল বুলা। হাসল সকলেই।
মাধবী এখন খুশী। মুখটুকু যতই সুন্দর হোক, সুন্দরী তাকেই বলে সব এড়িয়ে যাকে দেখতে ভালো লাগে। রমা সুন্দরী না হলেও লক্ষ্মীছিরি আছে। ওকে সামনে রেখে এখন ঘা দেওয়া যায়।
লেখাপড়াটাই তো সব নয়। আগে শরীর দেখতে হবে মা। শরীরই যদি গেল তা’হলে বিদ্যে দিয়ে কি হবে।
পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই ভাবছি মাসখানেক ওকে পাহাড়ে কোথায় পাঠিয়ে দোব। ওর এক বন্ধুর বাবা ইঞ্জিনিয়ার। পাঞ্জাবে থাকে, বেশ মোটা মাইনে পায় প্রায় দেড় হাজার, আমি তো বলেছি পরীক্ষাটা দিয়ে তোরা দুই বন্ধুতে চলে যা।
মাধবী চুপ করে রইল। বড়বৌ জুল জুল করে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল রমা আর মাধবী কেমনভাবে কথাটা গ্রহণ করল।
তোমার নন্দাই এবার পুজোর ছুটিতে মধুপুর যাবে ঠিক করেছে। অপিসের একজন দিন পনরো থেকেই নাকি হজমের গোলমাল সারিয়ে এসেছে।
-কোথাও গিয়ে যে হজমের ব্যায়রাম সারে এ কথা বাপু আমি বিশ্বাস করি না। খাঁটি জিনিস খাও, কোন অসুখ বিসুখের বালাই থাকবে না।
চুপ করে রইল বড়বৌ। সায় দেওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই। অবশ্য উত্তর একটা দেওয়া যায়, খাঁটি জিনিস আর কোথায় পাব? তা হলেই কথা বাড়বে। টাকা ফেললে বাঘের দুধ মেলে। সেই আবার টাকার কথার মত আসা। দরকার কি ওপথে যাবার। তার থেকে বরং পাত্রী দেখার প্রসঙ্গটুকু চলুক।
-কিগো বুলা, তুমি যে একেবারে চুপ?
সরু গলা খাঁকারি দিয়ে বুলা হাসল। তাকাল রমার মুখে। তারপর বড় বৌকে লক্ষ্য করেই বলল,
-গান জানে?
-ওইটি বাপু বলো না। এত মিষ্টি গলা, ওর মাকে কদ্দিন বলেছি মেয়েটাকে গান শেখাও, ওই তো সান্যালদের মেয়েটা কি ক্যারকেরে গলায় রেডিওয় গান গেয়ে মাস্টারি করে দিব্যি রোজগার করছে, বিদ্যে তো ঢুঁ ঢুঁ।
-দিন কতোক বুলারও বাতিক হল গান শিখব। মাস্টার রাখা হল। তারপর যা হবার তাই, মেয়ে বলল-ভাল লাগছে না।
বুলার মা মাধবীর দিকে তাকাল। মাধবীর মুখ কঠিন হয়ে গেছে। এ ঘরে যদি রমার বিয়ে হয় তাহলে মেয়ে সুখী হবে না। এরা উঠতি বড়লোক, নতুন সুখের মুখ দেখেছে, নতুন ধরনের কথাবার্তায় এদের আনন্দ। কিন্তু মনটা সেই ভাড়াটে বাড়ির মতই রয়ে গেছে। চট করে তো আর মনটাকে পাল্টে ফেলা যায় না, কিন্তু পাল্টাবার চেষ্টাটা খুব। তাই নতুন আর পুরোনোয় টানাটানি চলে যতক্ষণ না সম্পর্কটা ছিঁড়ে যায়। কিন্তু এ সম্পর্ক কি এক পুরুষে ছেঁড়ার? মধুসূদনবাবু বনেদী বড়লোকের ঘরের ছেলে। মাধবীর মধুসূদনকে মনে পড়ল এখন। ডালওলা একদিন নাকি দামের জন্য সামান্য গলা চড়িয়েছিল, তাই ক্ষেপে গিয়ে জুতো মেরেছিল। সারা বাড়ি অবাক হয়ে গেছল ওর পাগলামি দেখে। পাগলামি ছাড়া আর কি। নগদ দামে শুধু এ বাড়ি কেন, পাড়ার ক’জনই বা জিনিস কিনতে পারে। মিষ্টি কথায়, মিথ্যে কথায় ফিরিওয়ালাদের খুশি করে, আস্তে আস্তে দাম শোধ করতে হয়। গরীব হয়েও মধুসূদনবাবুর মান অপমান জ্ঞানটা টনটনে ছিল। পুরোনো সম্পর্কের বাঁধনটা একেবারে ছিঁড়ে ফেলতে পারেনি। আমাকে যারা দেখতে এসেছে তারাও পারেনি। এই দোটানার সংসারে আমার মত মেয়েরা শুধু নিজের দুঃখ বাড়ায়। কি হবে মেয়েটাকে সারা জীবন অসুখী করে। তার চেয়ে এরা তাড়াতাড়ি বিদেয় হোক।